Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিদেশে সন্তানেরা, শেষ দেখা দেখতে এখন ভরসা ফ্রিজার

হাতের মুঠোয় বিশ্ব। ইন্টারনেটের দৌলতে ভিডিয়ো কলে ক্যালিফর্নিয়ায় বসে কলকাতায় থাকা বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন ছেলে। দূর প্রবাসে বসে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী তরুণী খাবার সংস্থার অ্যাপ ঘেঁটে মা-বাবার বিবাহবার্ষিকীতে বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে দেন।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এমন ধরনের কফিনই এখন ব্যবহার হচ্ছে এ শহরে।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এমন ধরনের কফিনই এখন ব্যবহার হচ্ছে এ শহরে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:২৪
Share: Save:

হাতের মুঠোয় বিশ্ব। ইন্টারনেটের দৌলতে ভিডিয়ো কলে ক্যালিফর্নিয়ায় বসে কলকাতায় থাকা বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন ছেলে। দূর প্রবাসে বসে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী তরুণী খাবার সংস্থার অ্যাপ ঘেঁটে মা-বাবার বিবাহবার্ষিকীতে বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে দেন। এমন অনেক সুযোগ-সুবিধার সঙ্গেই এখন অভ্যস্ত কলকাতার বাঙালি। কিন্তু ছন্দপতন তখনই ঘটে, যখন পৃথিবীর দূর প্রান্তে বসে তেমনই কোনও নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর খবর পান তাঁরা। দূর প্রবাস থেকে প্রিয় মানুষটির শেষ যাত্রায় পৌঁছনোর আগে তাঁর মৃতদেহ সংরক্ষণের উপায় ভেবেই তাঁরা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ইন্টারনেটে দেহ সংরক্ষণ সংস্থার ফোন নম্বর খোঁজেন অথবা পরিচিতদের অনুরোধ করেন তেমন জায়গার হদিস দিতে।

বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে এমনই এক বাস্তব সমস্যার কথা বলেছিলেন কর্মকর্তা সন্দীপ মুখোপাধ্যায়। ওই পাড়ার অনেক পরিবারেই এখন বৃদ্ধ বাবা-মা একা থাকেন। ছেলেমেয়েরা চাকরির প্রয়োজনে বিদেশে রয়েছেন। সন্দীপবাবুর কথায়, ‘‘ছেলেমেয়েরা বিদেশে। প্রবীণ দম্পতিরা আমাদের কাছে এসে জানিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা মারা গেলে যেন সময়মতো তাঁদের অন্ত্যেষ্টি এবং পারলৌকিক কাজ আমরা নিয়ম মেনে সম্পন্ন করে দিই।’’ সন্দীপবাবু হিন্দু সৎকার সমিতিরও কর্মকর্তা।

পরিস্থিতি যখন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, তখনই শহরে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হচ্ছে মিনি ফ্রিজার কিংবা মৃতদেহ রাখার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কফিনের ব্যবসা। ওই কফিন সরবরাহকারী সংস্থাই মৃতের বাড়িতে পৌঁছে দেবে ফ্রিজার। বিদেশ থেকে আত্মীয়দের আসা পর্যন্ত মৃতদেহ থাকবে অবিকৃত।

বিস্তর খরচের কারণে বিদেশে থাকা সন্তানেরা প্রয়োজন হলেই কলকাতায় এসে মা-বাবার দেখভাল করতে পারেন না। সল্টলেক, নিউ টাউন, বালিগঞ্জ, সার্ভে পার্ক— বাড়িতে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একটাই চিন্তা, কিছু হলে দেখবে কে? একলা ঘরে মরে পড়ে থাকতে হবে। পুরসভার গাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাবে। ছেলের হাতের একটু জলও মিলবে না। মেয়েটার সঙ্গে শেষ দেখাটাও হবে না। বহুতল আবাসনের নিঃসঙ্গ প্রবীণরাও একই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। জরা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে তিলোত্তমা কলকাতার শরীরেও।

কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার জানাচ্ছেন, এমন কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেই সাত বছর আগে তাঁরা দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লাবের তরফে মৃতদেহ সংরক্ষণের মিনি ফ্রিজার বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কফিন চালু করেন। তাতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখা যায়। প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের দেহও সেই ফ্রিজারে রেখে দেওয়া হয়েছিল। দেবাশিসবাবুর কথায়, ‘‘মানুষের জীবনযাত্রা বদলাচ্ছে। রাতে পাড়ার খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও অ্যাপের দৌলতে মধ্যরাতেও বাড়িতে ভূরিভোজের ব্যবস্থা হচ্ছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানও তো বার করতে হবে। আমরা ওই ফ্রিজারে ৪৮ ঘণ্টা দেহ রাখার ব্যবস্থা করে দিই।’’

সম্প্রতি দমদমের একটি ফ্ল্যাটে রাতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গৃহকর্তা। ছেলে আমেরিকার বাসিন্দা। মেয়ে বিয়ের পরে পুণেতে। পরের দিন সকালে বৃদ্ধা স্ত্রী প্রতিবেশীদের সাহায্যে স্বামীর দেহ পিস হেভ্‌নে পাঠান। মেয়ে কলকাতায় এসেও প্রথমে বাবার দেহ দেখতে পাননি। চার দিন পরে ছেলে আমেরিকা থেকে এসে বাবার দেহ আনতে যান। তখনই ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে বাবার দেহের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পান।

ইন্টারনেটের দৌলতে জানা যাচ্ছে, দক্ষিণ ও উত্তর কলকাতায় এখন মৃতদেহ অবিকৃত রাখার ব্যবস্থা ব্যবসায়িক ভাবে চালু হয়েছে। পার্ক সার্কাসের কাছে এমনই একটি সংস্থা জানাচ্ছে, তাদের পরিষেবা সারা সপ্তাহ এবং ২৪ ঘণ্টা পাওয়া যায়। সংস্থার তরফে দেবু প্রসাদ বলেন, ‘‘দেহ রাখার জায়গা পাওয়াই তো ঝামেলার। আমরা মিনি ফ্রিজার বাড়িতে পৌঁছে দিই। ৪৮ ঘণ্টা দেহ সেই ফ্রিজারে রাখা যায়। তার পরে রাখতে হলে মৃতদেহে ওষুধ ও ইঞ্জেকশন দিতে হয়। তার ব্যবস্থাও আমরাই করি। শুধু মৃত ব্যক্তির বাড়ির একটি বিদ্যুতের পয়েন্টের সঙ্গে ফ্রিজারের সংযোগ করে দিলেই হয়ে যায়। মানুষ ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন।’’

একটি-দু’টি জায়গা ছাড়া মৃতদেহ সংরক্ষণের ঢালাও ব্যবস্থা আজও এ শহরে তেমন ভাবে নেই। পিস হেভ্‌নে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে একই সময়ে মাত্র ১১টি দেহ সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। কখনও সেখানে দেহ টানা ২০ থেকে ২৫ দিনও রাখা হয়। ফলে অনেক সময়ে চাইলেও কর্তৃপক্ষ দেহ রাখার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেন না। আবার অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম বাইরের দেহ নিজেদের ফ্রিজারে রাখতে রাজি হয় না।

তাই হোম ডেলিভারির মতোই বাড়িতে ফ্রিজার ভাড়া করে মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও সহজলভ্য হয়ে উঠছে কলকাতায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coffin Freezer Air Conditioned
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE