জামিন পাওয়ার পরে আনোয়ার। সোমবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
ভোটের বাংলায় নতুন পরিভাষা ‘জামিন-রাজনীতি’। এ বারের বিধানসভা ভোটের এক রকম আবিষ্কার বলা চলে! এখন বহু লোকের মুখে মুখে ঘুরছে এই শব্দবন্ধ।
জামিন-রাজনীতি। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে অনায়াসে জামিনে মুক্তি পাওয়া। ফৌজদারি মামলা ঝুলছে, অতএব ভোটের মুখে গ্রেফতার না করলে তো নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। কাজেই, গ্রেফতার হোক তারা, কিন্তু মামলা সাজানো হোক এমন ভাবে, যাতে কিছু দিনের মধ্যে জামিনে মুক্তি পেতে তাদের অসুবিধা না হয়।
যেমনটা হল সোমবার, শিয়ালদহ আদালতে। পুলিশের একাংশ ও বিরোধীরা যেমন আশঙ্কা করেছিলেন, তা-ই হল। ভোটের মুখে জামিনে মুক্তি পেলেন কাশীপুরে শাসক দলের আর এক নেতা আনোয়ার খান। গ্রেফতার হওয়ার দশ দিনের মাথায়, সোমবার আদালত তাঁকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে। এর আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন স্বপন চক্রবর্তী। কাশীপুরের এই তৃণমূল নেতা আনোয়ারের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বলে পরিচিত। অর্থাৎ, অতীতে কাশীপুরে ভোটের সময়ে জুলুমবাজিতে অভিযুক্ত শাসক দলের দুই নেতা এখন মুক্ত।
পুলিশের একটি সূত্রের খবর, কেবল স্বপন বা আনোয়ার নন, বেলেঘাটার তৃণমূল নেতা ও বহু অপরাধমূলক কার্যকলাপে অভিযুক্ত কানপুরিয়া শঙ্করের দুই ছেলে গবলু ও গদাইকে বেআইনি অস্ত্র-সহ গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু তারাও জামিনে ছাড়া পেয়েছে। শুধু বিরোধীরাই নন, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ, লোকসভা ভোট এবং পুরসভা ভোটে শাসক দলের হয়ে এরাই ‘ভোট করিয়েছিল’ বেলেঘাটায়। কানপুরিয়া শঙ্কর নিজেও অবশ্য জামিনে মুক্ত। একই ভাবে কসবা-তিলজলার দুষ্কৃতী সোনা পাপ্পু, মুন্না পাণ্ডের মতো দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে গুলি চালানো, তোলাবাজি, মারধর-সহ একগাদা অভিযোগ থাকলেও এখন জামিনে মুক্ত তারা।
বিরোধীদের অভিযোগ, আসলে এদের মধ্যে অনেকেরই গ্রেফতারি শুধু লোক-দেখানো নয়, স্রেফ ভাঁওতা ছিল। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে সহজে এদের জামিনে মুক্তির পিছনে রাজনৈতিক পরিচয় (বলা ভাল, শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা) কাজ করছে বলে পুলিশের একাংশই স্বীকার করে নিচ্ছেন। লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল অবশ্য বলেছেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’
সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘‘জন-সমর্থনের জমিন হারিয়ে তৃণমূল এখন জামিন রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে। আমরা কিন্তু ছাড়ছি না। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের গোচরে আনব। বলব, এরা বাইরে থাকা মানে ভোটের সময়ে সন্ত্রাসের আশঙ্কা রয়েছে।’’
কিন্তু কোনও মামলায় অভিযুক্তকে জামিনে মুক্তি তো আদালত দেয়। এখানে শাসক দলের কী ভূমিকা?
বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, ‘‘আদালতের নির্দেশে কেউ জামিনে মুক্তি পায় ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ কী ভাবে মামলাটি পেশ করছে, কেস ডায়েরিতে কী লিখছে, তার উপরেও জামিনে মুক্তি পাওয়া নির্ভর করে।’’
এ দিন যেমন শিয়ালদহ আদালতে আনোয়ার খানের আইনজীবী মহম্মদ সাজিদ দাবি করেন, অভিযোগপত্রে অভিযোগকারীর নাম মনা মণ্ডল লেখা থাকলেও এফআইআরে লেখা আছে মামণি মণ্ডল।
আবার অভিযোগকারী অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন, কিন্তু গোপন জবানবন্দিতে টিপ সই দিয়েছেন। সরকারি আইনজীবীও আনোয়ার খানকে আটকে রাখার পক্ষে তেমন জোরালো যুক্তি দেখাতে পারেননি বলে আদালত সূত্রের খবর।
পুলিশের একাংশের দাবি, জামিনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখলেই জানা যাবে, বহু ক্ষেত্রেই কেস ডায়েরিতে তদন্তে অগ্রগতির কথা লেখেননি তদন্তকারী অফিসারেরা। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘এই অবস্থায় কিন্তু অনেক সময়েই অভিযুক্তের জামিনে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়ে যায়।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, জামিন রাজনীতির জন্যই হরিদেবপুরের কবরডাঙায় পানশালার সামনে গুলিবৃষ্টিতে এক জনের খুনের ঘটনায় ধৃত দুই ভাই কালীপ্রসাদ সিংহ-দুর্গাপ্রসাদ সিংহ কিছু দিন আগে জামিনে মুক্ত হয়েছে।
যারা তৃণমূলকর্মী হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের কাছে পরিচিত। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওই দু’জনের মাথায় শাসক দলের এক নেতার হাত রয়েছে। হরিদেবপুরের ওই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত নান্টিও সদ্য জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘটনার পরেই নান্টির পরিবারের তরফে দাবি করা হয়েছিল সে এক তৃণমূল কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ। একই ভাবে জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বেলেঘাটার দাগি দুষ্কৃতী রাজু নস্কর-রবি নস্করেরা।
বিজেপি-র শমীকবাবুর বক্তব্য, ‘‘এ সব ঘটনাই প্রমাণ করে, তৃণমূল কী ভাবে প্রশাসনের রাজনীতিকরণ সম্পন্ন করেছে।’’
তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, ‘‘যার বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে তেমনই ধারা প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগের সারবত্তা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy