প্রোমোটার শেখর পোদ্দার।—ফাইল চিত্র।
এলাম, হুমকি দিলাম, গুলি করে চলে গেলাম!
শনিবার সকালে দমদম পার্কের একটি নির্মীয়মাণ বহুতলের একতলায় প্রোমোটার শেখর পোদ্দারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা যা জানিয়েছেন, তার নির্যাস অন্তত এটাই।
স্থানীয় সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে দমদম পার্কের চার নম্বর জলাধারের কাছে জনৈক নিরুপম সাহার জমি কিনে সেখানে একটি পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন শেখর ও তাঁর সহযোগী চিরদীপ রায়। এ দিন সেই নির্মীয়মাণ বহুতলের একতলাতেই গুলিবিদ্ধ হন শেখর। ঘটনার সময়ে সেখানেই ছিলেন চিরদীপ। বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রের খবর, ওই দু’জনের কাছে গত অগস্টে টাকা চেয়ে হুমকি-ফোন এসেছিল। তার পরে এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ দুই যুবক ঘটনাস্থলে এসে কাজ বন্ধের হুমকি দেয়। তা নিয়ে কথা কাটাকাটির মধ্যেই শেখরকে লক্ষ্য করে তারা গুলি চালিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রের খবর, পরপর তিন বার দুষ্কৃতীরা ওয়ান শটারের ট্রিগারে চাপ দিলেও গুলি বেরোয়নি। চতুর্থ বারের চেষ্টায় গুলি বেরিয়ে বছর পঞ্চান্নের শেখরের ডান হাতে লাগলে তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। পরে অবশ্য অস্ত্রোপচার করে গুলিটি বার করা হয়েছে।
কাজ হাসিলের পরে যে ভাবে দুই আততায়ী এলাকা ছেড়েছে, তা দেখে বাসিন্দারা স্তম্ভিত! নির্মীয়মাণ ওই বহুতলের পাশের ফ্ল্যাটের আবাসিক তনুশ্যাম চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আচমকা কালীপটকার মতো আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, টি-শার্ট ও জিনস পরা দু’টি ছেলে হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের দিকে চলে যাচ্ছে। এক জনের হাতের পিস্তল নামানো। আর এক জন সেটি উঁচু করে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে। কোনও ভয়ডর নেই।’’ স্থানীয় সূত্রের খবর, মোড়ের কাছে একটি বিউটি পার্লারের সামনে মোটরবাইক দাঁড় করানো ছিল। সেই বাইকে চেপেই ওই দু’জন এলাকা ছাড়ে। ওই দু’জন ছাড়া সঙ্গে আর কেউ ছিল কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ঘটনাস্থলের পাশেই দোতলা বাড়ির বাসিন্দা অভিজিৎ রায় বলেন, ‘‘প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কথা কাটাকাটির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। কারা চিৎকার করছে দেখতে বারান্দায় যাচ্ছিলাম। তখনই আওয়াজটা কানে আসে। বারান্দায় বেরিয়ে পিছন থেকে দুষ্কৃতীদের দেখতে পাই। ওদের হাতে একনলা পাইপের মতো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। হাঁটাচলা দেখে মনে হল, চূড়ান্ত বেপরোয়া। দমদম পার্কে এই ধরনের ঘটনা ভাবতে পারছি না!’’ নির্মীয়মাণ বহুতলটির নিরাপত্তারক্ষী কিষণ বর্মা বলেন, ‘‘দু’জন ক্রেতা আসায় তাঁদের নিয়ে শেখরবাবুর ভাগ্নে চারতলায় ওঠেন। সঙ্গে আমি এবং ঠিকাদার নাসের শেখ। ফ্ল্যাটে কী কী করতে হবে, তা নতুন ক্রেতারা বলছিলেন। সেই সময়ে আওয়াজ শুনে নীচে নেমে দেখি, শেখরদা বলছেন, গুলি মেরে দিল রে!’’ এ দিন ঘটনাস্থলে আসে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের দল।
অকুস্থলে: নির্মীয়মাণ সেই বহুতলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। শনিবার, দমদম পার্কে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
দিনেদুপুরে এমন একটি ঘটনা ঘটায় প্রশ্ন উঠেছে ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিধাননগর কমিশনারেটের ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘বাবু নায়েকের বিরুদ্ধে শেখরবাবুর ব্যবসার অংশীদার চিরদীপ রায় অভিযোগ জানিয়েছেন। দুই দুষ্কৃতী গুলি করে চলে যাওয়ার সময়ে কিছু টাকা ও গয়নাও নিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। আততায়ীদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। কিছু সূত্রও হাতে এসেছে। সব দিকই খতিয়ে দেখছি আমরা।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, শেখরবাবুর ব্যবসার অংশীদার চিরদীপ যে হেতু ঘটনাস্থলেই ছিলেন, তাই তাঁর ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চিরদীপ ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, কথা কাটাকাটির মধ্যেই যে হঠাৎ গুলি চলবে, তা তিনি ভাবতে পারেননি।
পুলিশ সূত্রের খবর, গুলি-কাণ্ডের নেপথ্যে এলাকার দুষ্কৃতী বাবু নায়েকের ভূমিকা রয়েছে বলে জেনেছেন তদন্তকারীরা। বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। অগস্টে লাখ পাঁচেক টাকা দাবি করে ওই প্রোমোটারের কাছে বাবুর ফোন গিয়েছিল বলে খবর।
স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসু বলেন, ‘‘বাবু নায়েক কিছু দিন আগে জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তার পরে অনেক প্রোমোটারের কাছেই হুমকি-ফোন গিয়েছে। গুলিবিদ্ধ প্রোমোটারও বাবুর কথাই বলেছেন বলে শুনেছি। পুলিশকে বলেছি, অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করলেই হবে না। এলাকায় যত এ ধরনের অপরাধী রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতির জন্য স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন তৃণমূল বিধায়ক। তাঁর কথায়, ‘‘বাবুকে জয়ের মালা পরিয়ে এলাকায় ঢুকেছিল বিজেপি-র পীযূষ কানোরিয়া। তার পর থেকেই তো একের পর এক ঘটনা।’’ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে পীযূষ বলেন, ‘‘পুর নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলের যে দুষ্কৃতীরা আমাকে মারার হুমকি দিয়েছিল, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কেন?’’
বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘এ রাজ্যে প্রোমোটার-রাজ, সিন্ডিকেট-রাজ তৃণমূলই চালাচ্ছে। এটাও তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। এখন দোষ ঢাকতে বিজেপি-র নাম দিচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy