Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
সন্দেহ ভবানীপুরে

প্রোমোটারিতে কাঁটা বিঁধলে খুনও কবুল

প্রথমে টাকার টোপ। না-গিললে হুমকি। তাতেও কাজ না হলে? তখন ‘বেয়াড়া’ ব্যক্তিটিকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিলে ঝামেলা চোকে। বাঁশ না থাকলে বাঁশি বাজবে কী করে? সোজা আঙুলে না-উঠলে এক শ্রেণির প্রোমোটার যে বাঁকা আঙুলেই ঘি ওঠাতে এবং আঙুল যতটা বেশি সম্ভব বাঁকা করতে তৈরি, সোমবার সকালে ভবানীপুরের বকুলবাগান রোডে নিজের বাড়ির নর্দমা থেকে এক প্রৌঢ়ার মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তারই ইঙ্গিত পাচ্ছে পুলিশ।

তদন্তে পুলিশ কুকুর। ছবি: সুমন বল্লভ

তদন্তে পুলিশ কুকুর। ছবি: সুমন বল্লভ

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৬ ০২:৫৩
Share: Save:

প্রথমে টাকার টোপ। না-গিললে হুমকি। তাতেও কাজ না হলে?

তখন ‘বেয়াড়া’ ব্যক্তিটিকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিলে ঝামেলা চোকে। বাঁশ না থাকলে বাঁশি বাজবে কী করে?

সোজা আঙুলে না-উঠলে এক শ্রেণির প্রোমোটার যে বাঁকা আঙুলেই ঘি ওঠাতে এবং আঙুল যতটা বেশি সম্ভব বাঁকা করতে তৈরি, সোমবার সকালে ভবানীপুরের বকুলবাগান রোডে নিজের বাড়ির নর্দমা থেকে এক প্রৌঢ়ার মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তারই ইঙ্গিত পাচ্ছে পুলিশ। যে ভাবে দেহটি পড়েছিল, তাতে তদন্তকারীদের কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঠেকছে না। উপরন্তু বৃদ্ধা আগেই এক প্রোমোটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।

সব মিলিয়ে প্রোমোটারি-রাজের হিংস্র ছায়া। বস্তুত লালবাজারের কর্তাদের একাংশের মতে, কোনও নির্মাণ বা বহুতল তৈরির পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে টাকা দিয়ে তাকে ওঠানোর চেষ্টা হয়। আর নোটের জোরে কাজ না-হলে খুন করাতেও দু’বার ভাবা হচ্ছে না। কর্তারাই মানছেন, কোথাও স্থানীয় থানার কিছু অফিসারও ওই সব প্রোমোটারদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রেখে চলেন।

গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, এ ভাবে ক্রমশ দাঁত-নখ বার করতে করতে খাস কলকাতার বনেদি আবাসিক তল্লাটেও অশুভ প্রোমোটার-চক্র আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে। তার কামড়ের জোর কতটা, সোমবার ভবানীপুরের ঘটনা তা-ই দেখিয়ে দিল। এ প্রসঙ্গে জেগে উঠছে সাড়া জাগানো সেই পোস্তা-কাণ্ডের স্মৃতি। সেটা কী?

জগমোহন মল্লিক লেনে হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার মালিক প্রভুশঙ্কর অগ্রবাল রেস্তোরাঁ খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। বাদ সাধেন লাগোয়া ন’ফুট বাই ন’ফুট চায়ের দোকানের মালিক সত্যনারায়ণ ঠাকুর। চার লাখ টাকার টোপ পেয়েও তিনি ওঠেননি। পরিণামে ২০০৫-এর ৩০ মার্চ রাতে দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারির সুপারি-খুনিরা তাঁর দোকানে চড়াও হয়। সেখানে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন সত্যনারায়ণের ভাগ্নে প্রমোদ শর্মা। কিন্তু চাদরের উপর দিয়ে চালানো গুলি প্রমোদের মাথার বদলে পায়ে লাগে। তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তদন্তে জানা যায়, কাঁটা সরতে গোপাল-গ্যাং’কে ছ’লাখ টাকার ‘সুপারি’ দেওয়া হয়েছিল। অগ্রিম তিরিশ হাজার।

প্রভুশঙ্কর, গোপালের যাবজ্জীবন হয়। পরে দু’জনের জামিনও হয়।

চমকে, ধমকে উচ্ছেদ শহরের বাণিজ্যিক তল্লাটে এর আগে যে চোরাগোপ্তা হয়নি, এমন নয়। তবে সুপারি-কিলার নিয়োগ হয়তো পোস্তাতেই প্রথম। প্রসঙ্গত, গত বছর পুরভোটের দিন বিকেলে গিরিশ পার্কে গোপাল তিওয়ারিরই সাঙ্গোপাঙ্গদের গুলিতে এক এসআই জখম হন। কিন্তু লালবাজার সূত্রের খবর, একই জায়গায় দাঁড়ানো এক যুবককে নিকেশ করাও হামলাবাজদের উদ্দেশ্য ছিল। এবং সেখানেও নেপথ্যে ছিল প্রোমোটারির অঙ্ক। কী রকম?

জানা যাচ্ছে, যুবকটি স্থানীয় এক বহুতলের ভাড়াটে। ৫০ লাখের লোভ দেখিয়েও তাঁকে ওঠানো যায়নি। এক কোটির দাবিতে তিনি গোঁ ধরে থাকেন। অগত্যা তাঁকে একেবারে ‘সরিয়ে’ ফেলার ছক কষা হয়। যার আড়াল হিসেবে সামনে খাড়া করা হয় ভোটের গণ্ডগোলকে।

কিন্তু ভবানীপুর তো বাণিজ্যিক অঞ্চল নয়! সেখানে প্রোমোটারেরা এত মরিয়া কেন?

সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের আর্থিক চালচিত্রের দিকে আঙুল তুলছে পুলিশের একাংশ। এক কর্তার কথায়, ‘‘শিল্প নেই, কারখানা নেই। মোটা টাকা রোজগারের মস্ত রাস্তা এখন প্রোমোটারি-ই। তাই বনেদি পাড়ার পুরনো বাড়ি কিনে মাল্টিস্টোরেড তোলার হিড়িক।’’

ভবানীপুরে যাঁর রহস্যমৃত্যুর পিছনে প্রোমোটারদের কালো হাতের ছায়া, সেই সুনন্দা গঙ্গোপাধ্যায়ের (৬০) বাড়িটাও তেমন। এমন বাড়ি কব্জা করে বহুতল খাড়া করতে পারলে বিপুল মুনাফার মওকা। ‘‘প্রোমোটারেরা আগে মোটা সুদে কোটি কোটি টাকা দেনা করে। পরে বাধা পেলে আঙুল বাঁকাতে কসুর করে না।’’— বলেন এক অফিসার। তাঁর মন্তব্য, ‘‘যদি দশ কোটি টাকা নিট লাভের সুযোগ থাকে, তা হলে কসুর করবেই বা কেন? সুপারি দেওয়া, খুনি ধরা পড়লে মামলার খরচ, জামিন, থানার একাংশকে ম্যানেজ করা ইত্যাদির পিছনে এক কোটি গলে গেলেও তো ন’কোটি লাভ থাকবে!’’

আসছে শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের প্রসঙ্গও। সেখানকার এক ‘বিতর্কিত’ জমি-বাড়ি কব্জা করতে সিকিওরিটি এজেন্সির লোক ভাড়া করে পাঠানো হয়েছিল। তাদের ঠেকাতে বাড়ির এক মহিলা গুলি ছোড়েন। দু’জনের প্রাণ যায়, গুরুতর জখম হয় এক জন। প্রোমোটারদের মদতের অভিযোগে স্থানীয় শেক্সপিয়র সরণি থানার এক অফিসার গ্রেফতার পর্যন্ত হয়েছিলেন।

অন্য তত্ত্বও শোনা যাচ্ছে। এক গোয়েন্দা-কর্তা বলন, ‘‘সব প্রোমোটার খারাপ, এমনটা নয়। এক কালের বহু সমাজবিরোধী এখন প্রোমোটারিতে ঢুকেছে। কিন্তু স্বভাব বদলায়নি। বেশি মুনাফার লোভে অন্ধকার জগৎকে তারা টেনে আনছে।’’ কাজেই বাড়ি-জমির দখলদারি ঘিরে শহরের ছাপোষা আবাসিক পাড়াতেও এখন হামেশা রক্ত ঝরছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder case Promoters Bhawanipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE