Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দুর্লভ শিল্পসামগ্রী বাঁচাতে হাতিয়ার গণ-তহবিলের অস্ত্র

দেখতে দেখতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণ গবেষক সুজান মুখোপাধ্যায়, শ্রুতকীর্তি দত্তদের ধমনীতে তখন ‘বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান’!

উদ্যোগ: গুরুসদয় মিউজ়িয়াম বাঁচাতেই শুরু হয়েছে তহবিল সংগ্রহ। ফাইল চিত্র

উদ্যোগ: গুরুসদয় মিউজ়িয়াম বাঁচাতেই শুরু হয়েছে তহবিল সংগ্রহ। ফাইল চিত্র

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০১:১৭
Share: Save:

খুলনার সুজনিকাঁথার দু’পিঠেই অবিশ্বাস্য নকশায় উনিশ শতকের বড়বাড়ির ভিতর ও বাহিরমহল! কিংবা মেদিনীপুরের পটচিত্রে রাজা হরিশ্চন্দ্রের গল্প। দ্বাদশ শতকের বীরভূমের আট হাতের দুর্গা থেকে উনিশ শতকের সেকালিনীদের ‘অস্ত্র’ মিষ্টি বা আমসত্ত্ব গড়ার সুদৃশ্য ছাঁচও এক ছাদের নীচে।

দেখতে দেখতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণ গবেষক সুজান মুখোপাধ্যায়, শ্রুতকীর্তি দত্তদের ধমনীতে তখন ‘বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান’! কয়েক দিন আগে অবিভক্ত বাংলার লোকশিল্পের এই উৎকর্ষ-ভাঁড়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সঙ্গীতশিল্পী, গবেষক মৌসুমী ভৌমিকও মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ‘চিত্রকর’ গানের হাবিব, ঢাকার হাবিবুর রহমানের কাঁথার কাজের প্রতি টানের কথা মনে পড়ছিল! এক সঙ্গে কত রেখা-রং বা স্বাদ-স্মৃতি মিউজ়িয়ামটিতে মিশে।’’

কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হওয়ায় জোকায় ডায়মন্ড হারবার রোডের কিনারে এই সংগ্রহশালাটির এখন কার্যত অনাথ অবস্থা। দেড় বছর ধরে কেন্দ্র-রাজ্যের দোরে দোরে ঘুরে হতাশ জনা ১২ কর্মচারী। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে কলকাতায় পড়ে-থাকা ইতিহাসের উদ্ধারটুকু বাঁচাতে অবশেষে তহবিল গড়ার ডাক দিয়েছে নাগরিক সমাজের একাংশ।

সুজান, শ্রুতকীর্তিরা মিলে একটি চিলতে ভিডিয়ো হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানোর পরেই অনেকের টনক নড়েছে। বিশ শতকের প্রথম ভাগে ব্রতচারী আন্দোলনের পুরোধা তথা ব্রিটিশ আমলের আইসিএস-কর্তা গুরুসদয় দত্তই জড়ো করেছিলেন দুর্লভ সব শিল্পসামগ্রী। হাজার চারেক আহরণের টুকরো ছাড়াও রয়েছে লোকসংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা নিয়ে হাজার সাতেক বইয়ের গ্রন্থাগার। এখনও এ রাজ্যে গবেষকেদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ। ‘সেভগুরুসদয়মিউজ়িয়ামডটকম’ বলে একটি ওয়েবসাইট খুলে সুজানরা কয়েক জন সংগ্রহশালাটি বাঁচানোর একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা খাড়া করেছেন। তাঁদের সুহৃদ তথা তাঁতশিল্পের পৃষ্ঠপোষক একটি বিপণির কর্ত্রী মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘লোকে কয়েক হাজার টাকা করে দিলেও অনেকটা সুরাহা হবে।’’ ফেসবুকে পেজ খুলে এবং অনলাইন মঞ্চ কেটো-য় মিউজ়িয়াম বাঁচানোর ডাক দিয়ে আপাতত ৯০ লক্ষ টাকা তোলার চেষ্টায় রয়েছেন আহ্বায়কেরা। তাতে দু’বছর সংগ্রহশালার খরচ সামলানো সম্ভব।

তবে টাকা তুলে কর্মচারীদের মাইনের সমস্যা মেটালেই সংগ্রহশালাটির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে না বলে মনে করেন ভারতীয় জাদুঘরের অধিকর্তা রাজেশ পুরোহিত। তাঁর মতে, ‘‘সংগ্রহশালাটি স্বনির্ভর করতে টাকা রোজগারের বন্দোবস্ত করাটাই আসল।’’ সেই মতো নানা পরিকল্পনাও উঠে আসছে। কারও মত, বাংলার লোকশিল্পের থিম মেলে ধরা বিভিন্ন পুজোর আয়োজকেদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা যায়। সংগ্রহশালায় মিষ্টির ছাঁচের সংগ্রহ মেলে ধরে নানা অনুষ্ঠানের ভাবনাও উঠে আসছে। চিত্রশিল্পী-সাংসদ যোগেন চৌধুরী বা ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতা এই চেষ্টায় উৎসাহ দিচ্ছেন। তহবিল গড়ার আহ্বায়কেরা ভাবছেন, ক্রমশ একটি কাফে গড়ে বা সংগ্রহশালা লাগোয়া চত্বরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে পূর্ব কলকাতায় স্বভূমি-র আদলে একটা সাংস্কৃতিক পরিসরই গড়ে উঠতে পারে।

১৯৬৩ সালে গড়ে ওঠা মিউজ়িয়ামটি গুরুসদয় দত্ত ফোক আর্ট সোসাইটি-র জিম্মায় রয়েছে এখন। তাতে ১৯৮৪ থেকে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রকের অনুদান আসছে। কেন বন্ধ হয়ে গেল, তা? কেন্দ্রীয় উন্নয়ন কমিশনার (হস্তশিল্প) শান্তমনুর কথায়, ‘‘সংগ্রহশালার উন্নয়নে প্রকল্প থাকলেও কর্মচারীদের মাইনেখাতে টাকা দিতে কেন্দ্র অপারগ।’’ সংগ্রহশালার কিউরেটর-সচিব বিজন মণ্ডল বা ভাইস চেয়ারম্যান কমলেশ চট্টোপাধ্যায়েরা রাজ্যেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ক্ষুদ্র শিল্পমন্ত্রকের একটি দল সংগ্রহশালাটিতে ঘুরে গেলেও এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্রবের গোড়া থেকেই সংগ্রহশালাটির যাত্রার সাক্ষী অবসরপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার। তিনি মনে করেন, ‘‘যা পরিস্থিতি, তাতে এই ঐতিহ্য বাঁচাতে সাধারণ নাগরিককে শরিক করে এগোনোটাই

ঠিক রাস্তা বলে মনে হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gurusaday Museum Fundraising
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE