Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
গল্ফক্লাব রোড

আত্মীয়তার সেই বন্ধন আজও অটুট

আমার পাড়া বলতেই একটা আত্মসম্পর্ক তৈরি হয়। আমার শরীর, আমার মন যেমন বলি, যে ভাবে বলি তুমি আমার— তেমনই পাড়াটাও তো আমার। পাড়ারও শরীর আছে, মন আছে, ধমনী আছে। তার ভাল লাগা আছে, মন্দ লাগা আছে। পাড়া কোনও মৃত স্তূপ নয়। বাস্তবে জীবনের আর এক নামই হল পাড়া।

রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৫ ০০:২৪
Share: Save:

আমার পাড়া বলতেই একটা আত্মসম্পর্ক তৈরি হয়। আমার শরীর, আমার মন যেমন বলি, যে ভাবে বলি তুমি আমার— তেমনই পাড়াটাও তো আমার। পাড়ারও শরীর আছে, মন আছে, ধমনী আছে। তার ভাল লাগা আছে, মন্দ লাগা আছে। পাড়া কোনও মৃত স্তূপ নয়। বাস্তবে জীবনের আর এক নামই হল পাড়া।

পাড়ায় নতুন কেউ এলে পাড়া আমাদের জানিয়ে দেয়। তাঁকে দু’হাত বাড়িয়ে আপন করে নেওয়া হয় জীবনের সুখে দুঃখে। কাউকে বঞ্চনা নয়, পরিত্যাগ নয়, যদি কারও কোনও কিছুর খামতি থাকে তাকে পূর্ণ করে দেওয়া। সব কিছুই নির্ভর করে পাড়ার প্রাসঙ্গিকতার উপরে। পাড়া মানেই নিছক থাকার জায়গা নয়। পাড়া মানেই সহমর্মিতা, পাশে থাকা, আরও অনেক কিছু...

গল্ফক্লাব রোড— আমাদের এই পাড়াটা একটা শান্ত, নিরুপদ্রব মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়া। সেই আশির দশক থেকে এ পাড়ায় আমার বসবাস। তার আগে থাকতাম গোলপার্কে। সেই সময় এ পাড়ায় বেশ কিছু পুরনো বাড়ি ছিল। তবে উঁচু বাড়ির সংখ্যাটা ছিল নেহাতই কম। পরে একটি দু’টি করে উঁচু বাড়ি তৈরি হল পাড়ায়। রাস্তায় তখন সন্ধে হলেই জ্বলে উঠত কম পাওয়ারের ডুম। মনে পড়ে আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও সন্ধ্যা হলেই মাঝেমাঝে লোডশেডিং হত। আর সেই অন্ধকার আচ্ছন্ন পাড়াটায় মনের সুখে ডানা মেলত জোনাকি। তাদের আর এখন দেখা মেলে না। কাছেই রয়েছে রয়্যাল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাব ও টালিগঞ্জ ক্লাব। এক কথায় অপূর্ব সবুজের সমাহার। কিছুটা দূরে আনোয়ার শাহ রোডের মোড়ে বিখ্যাত সেই মসজিদ, ঘড়িঘর আর টিপু সুলতানের পরিবারের নানা স্মৃতি।

দিনে দিনে এলাকাটা আরও উন্নত হল। গত কয়েক বছরে বাতিস্তম্ভগুলিতে বসেছে জোরালো আলো, রাস্তাঘাট প্রশস্ত হয়েছে।
তার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয়, রোজ নিয়ম করে জঞ্জাল সাফাই করা হয়। রাস্তার ধারে, নালায় ও ভ্যাটে ব্লিচিং ছড়ানো হয়। আগে বৃষ্টিতে জল জমলেও এখন তা আর জমে না। এলাকার দোকানপাট বাজারও বেশ ভাল। মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। এখানকার কাউন্সিলার নিয়মিত পাড়ার মানুষের খোঁজখবর রাখেন, দেখা হলে হেসে কথাও বলেন।

এ পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডাটা সত্যি চোখে পড়ার মতো। সব বয়সের মানুষই ভিড় করেন সেখানে। তাঁদের আলোচনার বিষয়ও এক এক রকম। আজও এ পাড়ার মানুষের মধ্যে একটা মেলবন্ধন বা যোগাযোগ আছে যার টানে যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে আমরা সকলে মিলিত হই। তা সে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনই হোক বা পাড়ার পত্তনদিবস। সারাটা বছর অপেক্ষা করে থাকি পুজোর দিনগুলোর জন্য। পুজোর চারদিন পা়ড়ার মণ্ডপে একসঙ্গে বসে আড্ডা-গল্পগুজব আর খাওয়াদাওয়া। এ পাড়ায় পুজোটা কতটা প্রাণবন্ত সেটা বোঝা যায় বিজয়া দশমীর দিনে। কমবেশি সকলের চোখ যেন ছলছল করে।

বলতে ভাল লাগছে আজও এ পাড়ায় সে ভাবে কোনও বহুতল আবাসন তৈরি হয়নি। মোটামুটি সব ক’টিই বাড়ি। কোনওটা দোতলা, কোনওটা বা তেতলা। তবে দেখতে পাই কিছু মানুষের পাড়ার পুরনো বাড়ি ছেড়ে বহুতলে বসবাস করার প্রবণতা। কিন্তু এই সব বহুতল আবাসনগুলিতে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হতে সমস্যা হয়। এখনকার ফ্ল্যাট কালচারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেউ কাউকে চেনেন না, জানেন না আর হয়তো চিনতে বা জানতেও চান না। এর কারণ বিভিন্ন মানসিকতার লোক এসে সেটাকে শুধু একটা থাকায় জায়গা মনে করেন। আমার মনে হয় সেখানে অর্থনৈতিক বিভাজনটা খুব স্পষ্ট। তাই
মন থেকে তৈরি হয় না কোনও টান বা আবেগ। আমি পরিবর্তনকে খারাপ বলছি না। তবে পাড়ার অস্তিত্বটা যদি ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায় তা হলে সেটা খুব ক্ষতিকারক।

আর আজও এ পাড়ায় কাউকে কোনও ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে নতুন যে কেউ নিশ্চিত পৌঁছে যাবেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এই যে আত্মসম্পর্কটা পাড়ায় তৈরি হয় এটা ফ্ল্যাট কালচারে হয় না। এ পাড়ায় আজও প্রতিবেশীদের মধ্যে সেই আত্মসম্পর্কটা বজায় আছে। কেউ কোনও সমস্যায় পড়েছেন শুনলে প্রতিবেশীরা গিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পাড়ার ক্লাবের সদস্যরা বিপদে আপদে সব সময়ই আমাদের পাশে থাকেন। আমার স্ত্রী যখন অসুস্থ হয়েছিলেন তখন পাড়ার ছেলেরাই এগিয়ে এসে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। এমন আন্তরিকতা আর কোথায় পাব?

প্রতি দিন প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে পাড়া সংলগ্ন পুরনো ওই কবরখানাটায় একটা দৃশ্য দেখে মনে মনে কৌতুক বোধ করি। কয়েকটা চওড়া চাতালের কবরের উপরে কিছু মানুষ নিয়মিত ব্যায়াম করেন। সেই দৃশ্য দেখে আমার খালি মনে হয় কবরের নীচে মানুষটা শুয়ে শুয়ে হাসতে হাসতে বলছেন, ‘যতই ব্যায়াম করো এক দিন তোমাকেও নীচে আসতে হবে।’

তাই আজও ভাল লাগে এ পাড়ায় মানুষের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতা দেখে। নবীনরা আজও প্রবীণদের সমীহ করেন, শ্রদ্ধা করেন। হয়তো গাছতলায় বসে কিছু ছেলে জোরে জোরে কথা বলছে, পাশ দিয়ে পরিচিত কোনও প্রবীণ মানুষ গেলে গলার স্বরটা নামিয়ে নেন তাঁরা।

এ পাড়ায় নানা গুণী মানুষের বসবাস। এক সময় কাছেই থাকতেন ভূপেন হাজরিকা ও অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। আর কিছুটা দূরেই ফার্স্ট লেনেই ছিল উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্করের পুরনো বাড়িটা। সেখানে আজ দাঁড়িয়ে বহুতল।

আগে ছোটরা পাড়ার রাস্তায় খেলত, পরে এলাকার মানুষের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে একটি খেলার মাঠ। আর দেখতে পাই না সেই বায়েস্কোপওয়ালাকে যাঁকে ঘিরে পাড়ার কচিকাঁচারা ভিড় করত এই সেদিনও। আর কোথায় গেল সেই পুতুলওয়ালা, যাঁর ঝুড়িতে থাকত নানা রকমের পুতুল? বাড়িতে বসে ভোররাতে আর শুনতে পাই না ট্রামের সেই ঠংঠং শব্দটা। সেটাও কি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে?

লেখক বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE