ঘোরা: একটি পুজোমণ্ডপে ভারতীয় গোর্খা সঙ্ঘের সদস্যরা। নিজস্ব চিত্র
১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ঘরে মহালয়ার আগে থেকেই গিজগিজ করছে লোক। রাতের রান্না শেষ হলে কয়েক জনকে আবার শুতে হচ্ছে ঘরের সামনে এক চিলতে উঠোনেই। প্রতিপদ পার করে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের আর রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট লাগোয়া ‘চানা গলি’র ওই ঘর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াই হয়নি। তাঁদের জায়গা হয়েছে বৈঠকখানা বাজার লাগোয়া হোটেলে। ঘরের কর্তা, পেশায় ফুচকা বিক্রেতা সুধীর সোনকর বললেন, ‘‘লক্ষ্মীসরাইয়ের দেশের বাড়ি থেকে অনেকে এসেছে। ছোট ঘরে এত জনের তো হয় না! অনেকে তাই হোটেলে উঠেছে।’’
একই চিত্র গল্ফ গ্রিন রোডের ঝোড়ো বস্তিতে। উত্তরপ্রদেশের গ্রামের বাড়ি থেকে আত্মীয়েরা আসবেন বলে পুজোর আগেই সেখানে পাশের ফাঁকা ঘর ভাড়ায় নিয়ে রেখেছিলেন সনাতন ভরদ্বাজ। জানালেন, ভাড়ার ঘর থেকেই প্রতিমা দর্শন চলেছে তাঁর আত্মীয়দের। অনেকেই থেকে গিয়েছেন। কলকাতায় আরও একটু ঘুরে বাড়ি ফিরবেন।
পুজো এবং কলকাতা ঘিরে বরাবরের মতো এ বারও এমনই উন্মাদনা ছিল ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে। কেউ এ শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেই বেরিয়ে পড়েছেন মণ্ডপ ঘুরতে। কারও আবার প্রতিমা দর্শনের থেকেও বড় ‘ডেস্টিনেশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কালীঘাট মন্দির, বাবুঘাট, ধর্মতলা বা চিড়িয়াখানা। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে তাঁদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে আবার জানিয়েছেন, কলকাতায় আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে প্রতিমা দর্শনের পাশাপাশি নবরাত্রি পালন করেছেন। রীতি মেনে করা হয়েছে ন’কন্যার পুজোও। অষ্টমীর সন্ধ্যায় শোভাবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে জনা আটেকের ভিড়ের মধ্যে থেকে এক জন আবার বললেন, ‘‘মেট্রো যেন কোন দিকে? সেটা না দেখলেও তো কলকাতা দেখা হয় না!’’
কলকাতা পুরসভার ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অসীম বসু জানালেন, তাঁর ওয়ার্ডে প্রচুর গুজরাতি এবং ওড়িয়ার বাস। প্রায় সকলের বাড়িতেই পুজোর এই সময়ে দূরের আত্মীয়েরা থাকতে আসেন। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অসীমবাবুর কথায়, ‘‘দুর্গোৎসব সকলের। আমাদের পাড়ার বেশ কয়েকটি পুজোর কর্মকর্তা অবাংলাভাষী। মুখ্যমন্ত্রীর কার্নিভালে শুক্রবার এক গুজরাতি কর্তা হাঁটবেন চক্রবেড়িয়ার প্রতিমা নিয়ে।’’ যাদবপুর থানায় কর্তব্যরত পুলিশকর্মী বিকি সোনকর আবার বলছিলেন, ‘‘ষষ্ঠীর বোধন থেকে কলকাতার পুজো শুরু হলেও বহু রাজ্যে কিন্তু প্রতিপদ থেকেই পুজো শুরু হয়ে যায়। আমরা ওই দিনটাকে প্রথম বলি। নবরাত্রির পরে ন’কন্যার পুজো দিয়ে বিজয়া দশমী। এর পরে প্রস্তুতি চলে ছটপুজোর।’’
প্রতিপদ থেকে পুজো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা শোনাচ্ছিলেন ভারতীয় গোর্খা সঙ্ঘের সদস্যেরাও। হেস্টিংস ক্যানাল রোডের পুজো ঘিরে ছিল তাঁদের জমজমাট আয়োজন। অষ্টমীর দুপুরে ভোগ বিতরণে ব্যস্ত তাঁদেরই এক জন বলছিলেন, ‘‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। উত্তরের দিকের ঠাকুরগুলো আজই দেখে ফেলতে হবে। নবমীতে দক্ষিণ কলকাতায় যাব।’’ একই রকম ব্যস্ততা ভূকৈলাস রোডের কয়েক ঘর নেপালিদের মধ্যেও। রাজু প্রধান নামে তাঁদের এক জনের কথায়, ‘‘ঠাকুর দেখা শেষ। এ বার কলকাতায় একটু ঘুরে আত্মীয়েরা ফিরে যাবেন।’’
নিজের নেপালি স্ত্রীর উদাহরণ দিয়ে কলকাতা পুরসভার ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রামপিয়ারি রাম আবার বললেন, ‘‘কলকাতার পুজো আর আলাদা মনে হয় না। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে যাঁরা আসেন, তাঁরা এত দ্রুত ফিরতে চান না। পুজো শেষ হলেও তাঁদের এখনও অনেক কিছু দেখা বাকি।’’ একডালিয়া এভারগ্রিনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক হিন্দিভাষী আবার জানালেন, তাঁরও দেখার বাকি অনেক। শুনেছেন, জগৎ মুখার্জি পার্কে বারাণসীর মন্দির করেছে। নিজের রাজ্যের মন্দির কলকাতায় কেমন লাগছে, না দেখলে কি চলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy