Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাজ পড়লেই ভয় পরির ‘ডাক্তারবাবু’র

‘‘আসলে পরির সঙ্গে একটা নাড়ির টান হয়ে গিয়েছে বুঝলেন। তাই বর্ষার সময়টা চিন্তা থাকেই। ইদানীং মুহুর্মুহু বজ্রপাতও তো হচ্ছে!’’

পরি-দর্শন: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পরির স্বাস্থ্য পরীক্ষায় মন্টু দাস।

পরি-দর্শন: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পরির স্বাস্থ্য পরীক্ষায় মন্টু দাস।

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৮ ০৩:১৩
Share: Save:

বাজ পড়া শুরু হলে দুশ্চিন্তা শুরু হয় মন্টু দাসের। ক’টা বাজ পড়ল দমদমের বাড়িতে বসে গুনতে থাকেন মন্টুবাবু। ‘‘টানা দশ-পনেরোটা বাজ পড়তে থাকলে টেনশন হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করি। সব ঠিক আছে তো?’’ সব ঠিক থাকলে কিছুটা নিশ্চিন্ত। যদিও তা সাময়িক। পরের দিনই সশরীরে হাজির হয়ে যান ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। পরির খোঁজ করতে! হবে না-ই বা কেন। গত ১০ বছর ধরে ভিক্টোরিয়ার পরির ‘ডাক্তারবাবু’ যে তিনিই! পরি ঠিক আছে কি না, পরির স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে কি না, সে সবই জেসপের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার মন্টুবাবুর নখদপর্ণে।

‘‘আসলে পরির সঙ্গে একটা নাড়ির টান হয়ে গিয়েছে বুঝলেন। তাই বর্ষার সময়টা চিন্তা থাকেই। ইদানীং মুহুর্মুহু বজ্রপাতও তো হচ্ছে!’’— বলছেন বছর বাষট্টির মন্টুবাবু। ভিক্টোরিয়ার সংগৃহীত তথ্য বলছে, অতীতে দু’বার বজ্রপাতের কারণেই ভিক্টোরিয়ার পরির ঘূর্ণন থেমে গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে প্রথম বার বাজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পরি। তার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও জেসপের যৌথ তত্ত্বাবধানে তা ফের ঠিক করা হয়। ২০০৬-’০৭ সালে দ্বিতীয় বার বাজ পড়ে ক্ষতি হয়েছিল পরির। সে বার জেসপের তরফে প্রথমে একটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে পরির স্বাস্থ্যহানির কারণ ধরা যায়নি। দ্বিতীয় বার যে দলটি পরির স্বাস্থ্য উদ্ধারে এসেছিল, তার সঙ্গেই ছিলেন মন্টুবাবু। মন্টুবাবু বলছেন, ‘‘বাজ পড়লে পরির নীচে থাকা বল-বেয়ারিং-এর ক্ষতি হয়ে পরস্পর জোড়া লেগে যায়। সেগুলি আলাদা না করলে পরি ঘোরে না। সেই বল-বেয়ারিং খুব আস্তে আস্তে আলাদা করতে হয়।’’

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সূত্রে খবর, যে গম্বুজের উপরে পরিটি বসানো রয়েছে, তার উচ্চতা মাটি থেকে ৫৬ মিটার। পরির উচ্চতা হল ৫.৯ মিটার। ‘বায়োডেটা অব দি এঞ্জেল’ নামে পরি সংক্রান্ত ভিক্টোরিয়ার পুরনো নথি এও বলছে, ১৯২১ সালে প্রায় সাড়ে ছয় টন ওজনের ওই পরিকে যখন ভিক্টোরিয়ার মাথায় বসানো হয়েছিল, তখন তার ঘুরতে ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার গতির হাওয়া দরকার হত। কিন্তু বর্তমানে সেই পরীর ঘুরতে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার হাওয়া প্রয়োজন। কারণ, বল-বেয়ারিংয়ের যে প্রযুক্তির সাহায্যে ওই পরি ঘোরে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষয় হয়েছে।

ভিক্টোরিয়ার বাইরে পরির গল্প শোনাচ্ছেন ‘ডাক্তারবাবু’। বাঁ দিকে পরির নকশা।

মন্টুবাবু বলছেন, বল-বেয়ারিং তো বটেই, বাজ পড়ার মরসুমে মূলত তিনটি দিকে নজর রাখতে হয়। তাঁর কথায়, ‘‘পরির নিচে দু’টি পাত্র রয়েছে। একটি পারদের ও অন্যটি গিয়ার তেলের। বজ্রপাতের সময়ে ওই পারদ ‘আর্থিং’-এর কাজ করে। বাজ পড়তে থাকলে পাত্র থেকে পারদের ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে টানা বাজ পড়তে থাকলে পুরো পারদ শেষ হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তা থাকেই। তখন সেই পাত্র পূরণ করতে হয়। আরও একটি পাত্রে সাত-আট লিটার তেল থাকে। ওই তেল বল-বেয়ারিং সচল রাখতে সাহায্য করে।’’ বল-বেয়ারিংয়ের এক বার ক্ষতি হলে প্রায় ১০-১৫ কোটি টাকা খরচ হবে। পরিকেই তখন নামাতে হতে পারে বলে জানাচ্ছেন মন্টুবাবু। তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর-সেক্রেটারি জয়ন্ত সেনগুপ্ত নিশ্চিন্ত পরির ‘ডাক্তারবাবু’কে নিয়ে। জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘পরির দেখভাল তো মন্টুবাবুই করেন। আমাদের তরফেও নজর রাখা হয়।’’

শুক্রবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পরির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে এসেছিলেন মন্টুবাবু। পরিটি যে গম্বুজের উপরে বসানো রয়েছে, তার ভিতরে ঘোরানো একটি সিঁড়ি রয়েছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে পরির কাছে পৌঁছতে হয়। সেই সিঁড়িতে ওঠার আগে অবশ্য লগ-বুকে সই করতে হয় পরির ‘ডাক্তারবাবু’কে। লগ-বুকে সই করে উপরে উঠে গেলেন মন্টুবাবু। ওঠার আগে তাঁর মুখে চিন্তার রেখা। সেই বাজের চিন্তা! আধ ঘণ্টা পরে নীচে নেমে এসে বললেন, ‘‘পরি ভালই আছে!’’

আর চিন্তা নেই! ‘ডাক্তারবাবু’র মুখে তখন স্বস্তির হাসি।

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mantu Das Victoria Memorial Fairy lightening
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE