Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
আলিপুরে আক্রান্ত রূপা

গালিগালাজ, মঞ্চ থেকে ফেলার চেষ্টা

এই পুরভোটের পর্বে বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের উপর শাসক দলের চড়াও হওয়ার অভিযোগ ছিলই। এ বার সেই আঁচ লাগল রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তারকার গায়েও। মঙ্গলবার বিকেলে আলিপুরের গোপালনগর মোড়ে কলকাতা পুরসভার ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী প্রমিতা দত্তের সমর্থনে প্রচারসভায় গিয়ে আক্রান্ত হন রূপা। অভিযোগ, বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ পুলিশের সামনেই বিজেপির সভামঞ্চে তাণ্ডব করা হয় এবং ভাঙচুর চালিয়ে বিজেপির পতাকা ছিঁড়ে সেখানে তৃণমূলের পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হয়।

আক্রান্ত বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। মঙ্গলবার গোপালনগর মোড়ের প্রচারসভায় প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

আক্রান্ত বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। মঙ্গলবার গোপালনগর মোড়ের প্রচারসভায় প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৮
Share: Save:

এই পুরভোটের পর্বে বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের উপর শাসক দলের চড়াও হওয়ার অভিযোগ ছিলই। এ বার সেই আঁচ লাগল রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তারকার গায়েও।

মঙ্গলবার বিকেলে আলিপুরের গোপালনগর মোড়ে কলকাতা পুরসভার ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী প্রমিতা দত্তের সমর্থনে প্রচারসভায় গিয়ে আক্রান্ত হন রূপা। অভিযোগ, বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ পুলিশের সামনেই বিজেপির সভামঞ্চে তাণ্ডব করা হয় এবং ভাঙচুর চালিয়ে বিজেপির পতাকা ছিঁড়ে সেখানে তৃণমূলের পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হয়। আরও অভিযোগ, তৃণমূল কর্মীরা বিজেপির প্রার্থী এবং কর্মীদের মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলেন। প্রার্থীকে মারধরও করা হয়। রূপা তখন ওই সভারই পথে। ফোনে তাণ্ডবের খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছলে তৃণমূল তাঁর উপরেও চড়াও হয় বলে অভিযোগ। তাঁর গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।

পরে আলিপুর থানায় অভিযোগ জানাতে ঢোকার আগে রূপা বলেন, তিনি সভাস্থলে গিয়ে দেখেন, মঞ্চে ওঠার সিঁড়ি তৃণমূলের লোকজনের দখলে। রূপার অভিযোগ, তিনি মঞ্চে উঠতে গেলে তারা বাধা দেয়। সেই বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি মঞ্চে ওঠেন এবং মাইক হাতে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। রূপার কথায়, ‘‘আমি তখন বলি, সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সভা করার জন্য পুলিশ আমাদের অনুমতি দিয়েছে। তা হলে এখন এখানে এই পতাকাগুলোর (তৃণমূলের পতাকা) দরকার নেই। এই বলে আমি পতাকাগুলো খুলতে শুরু করি। সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের লোকেরা আমার উপর চড়াও হয়।’’ রূপার দাবি, তাঁকে ধাক্কা দেওয়া হয়। অশ্রাব্য গালিগালাজ করা হয়। মঞ্চ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়। আক্রান্ত হন উপস্থিত চিত্রসাংবাদিকও।

পরে আলিপুর থানায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় অভিযোগ দায়ের করে বিজেপি। এর মধ্যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ (খুনের চেষ্টা), ৩২৪ (মারাত্মক অস্ত্র দিয়ে ইচ্ছে করে আঘাত) এবং ৩৫৪-এর (শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও মহিলার উপরে হামলা) মতো জামিন অযোগ্য ধারা রয়েছে। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি। এই আলিপুর থানাতেই গত বছরের ১৪ নভেম্বর তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হামলা থেকে বাঁচতে টেবিলের তলায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল পুলিশকে। সেই ঘটনায় অভিযোগের আঙুল ওঠে তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার দলবলের বিরুদ্ধে। এ দিন রূপার উপর হামলাতেও প্রতাপবাবুর অনুগামীরাই ছিল বলে পুলিশের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে। প্রতাপবাবু অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ঘটনা হল, তৃণমূলও এ দিন বিজেপির বিরুদ্ধে পতাকা ছেঁড়ার অভিযোগ করে আলিপুর থানাতেই। সেখানে ৩৫৪ বাদে বাকি একই সব ধারাতেই মামলা হয়েছে। সে কথা জেনে রূপার জবাব, ‘‘অভিযোগ হলে মোকাবিলা করব। তবে পরিবর্তন আনবই।’’ নির্বাচন কমিশনকেও অভিযোগ জানায় বিজেপি।

বিজেপির তারকা প্রার্থীর উপরে হামলার ঘটনা অবশ্য এই প্রথম নয়। লোকসভা ভোটে আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়কে নানা ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। বাবুল মদ্যপ অবস্থায় প্রচারে গিয়েছেন থেকে শুরু করে তাঁর মিছিলে অস্ত্র নিয়ে লোকজন ছিল— সব রকম অভিযোগই করা হয়েছিল সেই সময়। রূপার ক্ষেত্রেও একই ভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে কি না, বিজেপির তারকা প্রার্থী প্রচারে নামায় তাঁরা আতঙ্কিত কি না— এই সব প্রশ্নের জবাবই উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। তবে কেউ কেউ রূপাকে কটাক্ষ করতেও ছাড়ছেন না। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘‘এমন এক জনের নাম শুনলাম, যিনি বিজেপির মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন, অথচ ভোটার তালিকাতে নামই ছিল না! এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে?’’ ঘটনাটি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এরা নিজেরাই এ সব করে। পরে অন্যের নামে অভিযোগ দেয়। এরা যত কুৎসা করবে, মানুষ ততই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আস্থা রাখবে।’’

রাজ্যের মন্ত্রী ও আলিপুরের বিধায়ক ফিরহাদ (ববি) হাকিম ঘটনাটিকে বিজেপির নাটক বলে উল্লেখ করে অভিযোগ করেছেন, ‘‘বিজেপির মঞ্চের পিছনে আগে থেকেই তৃণমূলের বেশ কিছু ব্যানার, পতাকা লাগানো ছিল। রূপা ও তাঁর লোকজন সেই পতাকা, ব্যানার ছিঁড়তে শুরু করেন। তখন স্থানীয়রা প্রতিবাদ করেন। তার পরেই রূপা নাটক শুরু করেন।’’

প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, বিজেপির মঞ্চে চড়াও হয়েছিল বেশ কিছু লোক। এমনকী, ঘটনার পরে রূপাকে দৃশ্যতই বিধ্বস্ত লাগছিল। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি অনেক বস্তিতে ঘুরেছি। অনেক মানুষ দেখেছি। এখানে আজ যে জনা দশেক ছেলে এবং জনা পাঁচেক মেয়েকে দেখলাম, তাদের মতো কদর্য মানুষ আগে দেখিনি। এরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাঁচে গড়া। যেমন শিখেছে, তেমন ভাষাতেই গালাগাল দিয়েছে।’’ পরে সিদ্ধার্থনাথ বলেন, ‘‘বিহারে যেমন জঙ্গলরাজ ছিল, মমতা জমানায় পশ্চিমবঙ্গেও তেমন শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রে (যদিও ঘটনাস্থল মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র নয়। তাঁর বাড়ির অনতিদূরে) আজ যা ঘটল, তা প্রমাণ করে রাজ্যের কী অবস্থা! আইনশৃঙ্খলা যে ভাবে ভেঙে পড়েছে, তাতে বিষয়টা রাষ্ট্রপতি শাসনের দিকেই যাচ্ছে।’’ তাঁর চ্যালেঞ্জ, ‘‘জবাব দেব। তবে গণতান্ত্রিক পথে। চূড়ান্ত ফল বেরোবে ২০১৬-য়।’’

হাঙ্গামার খবর পেয়ে আলিপুর থানায় যান বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়-সহ দলীয় নেতৃত্ব। প্রমিতা গোটা ঘটনার বিবরণ দিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। তৃণমূল অবশ্য বিজেপির বিরুদ্ধে তাদের পতাকা ছেঁড়ার পাল্টা অভিযোগ জানায় আলিপুর থানাতেই।

রাজনীতিকরা বলছেন, গোপালনগরের অন্য ‘স্থানমাহাত্ম্য’ রয়েছে। একদা এই গোপালনগরেই গলায় শাল জড়িয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি যুব কংগ্রেস নেত্রী। সে দিন তাঁর অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকায় কিছু সমাজবিরোধী ঠাঁই পেয়েছে, তাদের বাদ দিতে হবে। আর এ দিন এখানেই দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হলেন বিজেপি নেত্রী রূপা।

ঘটনাটির নিন্দা করছেন সব বিরোধীই। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ঘটনার জন্য তৃণমূলকে দায়ী করে বলেছেন, ‘‘এদের শিক্ষা দেওয়া দরকার। কিশোরী থেকে সন্ন্যাসিনী কেউই নিরাপদ নন। সেখানে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে ওরা ছাড়বে কেন?’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিরোধী, নির্দল, এমনকী নিজেদের দলের বিক্ষুব্ধরাও কেউ তৃণমূলের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নারী সমাজের সম্মাননীয় প্রতিনিধি রূপার গায়ে হাত দিতেও তাদের বাধে না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE