Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ডালপালা মেলছে গুজব, নেপথ্যে কারা

এ দিন দুপুরে পশ্চিম চৌবাগায় গিয়ে দেখা গেল পরিবেশ থমথম। রাস্তায় ইতস্তত জটলা। ভয়ে অনেক বাড়িতেই পুরুষ ও মহিলারা কাজে বেরোননি। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাননি অনেকেই।

হেনস্থা: রবিবার চৌবাগায় গণপিটুনি যুবককে। নিজস্ব চিত্র

হেনস্থা: রবিবার চৌবাগায় গণপিটুনি যুবককে। নিজস্ব চিত্র

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪১
Share: Save:

বেলা দেড়টা, সোমবার। রে রে করে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় ছুটলেন স্থানীয় লোকজন। স্কুল থেকে নাকি উধাও হয়ে গিয়েছে দু’টি শিশু। খবর পেয়ে পৌঁছল পুলিশও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেল একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির ছাদ থেকে দু’টি ইট খসে পড়েছে। এমনটাই পরিস্থিতি আনন্দপুর থানার অধীনে পশ্চিম চৌবাগায়। রবিবার রাতে ওই এলাকাতেই বাচ্চা চুরির গুজবে বছর ত্রিশের এক যুবক গণপিটুনিতে আক্রান্ত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। এ দিন রাতে হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় শিশু চুরির সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে।

এ দিন দুপুরে পশ্চিম চৌবাগায় গিয়ে দেখা গেল পরিবেশ থমথম। রাস্তায় ইতস্তত জটলা। ভয়ে অনেক বাড়িতেই পুরুষ ও মহিলারা কাজে বেরোননি। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাননি অনেকেই।

কিন্তু কীসের ভয়? বাসিন্দাদের বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর ছড়িয়েছে এলাকায় হানা দিচ্ছে বাচ্চা চোরেদের দল। যারা নাকি জল খাওয়ার নাম করে বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের কিডনিও কেটে নিয়ে যাচ্ছে। গুজবে কান না দিতে পুলিশ এলাকায় লিফলেট বিলি করছে। অটোয় মাইক নিয়ে প্রচারও চালাচ্ছে। কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হচ্ছেন না লোকজন। ভয় যেন মনের মধ্যে চেপে বসেছে।

কিন্তু এমন গুজব ছড়ানোর পিছনে কাদের হাত রয়েছে? কারা মানুষকে ভয় পাওয়াচ্ছে? কারা গণপিটুনির মতো বেআইনি কাজে ইন্ধন দিচ্ছে— তার জবাব নেই পুলিশ প্রশাসনের কাছেও। দিন কয়েক আগে কসবা অঞ্চলেই এক মহিলা নিজের সন্তানের খোঁজ করতে গিয়ে শিশু চুরির গুজবে

গণপিটুনিতে আক্রান্ত হন। পরিস্থিতি এমনই যে সোমবার আনন্দপুর থানার পুলিশকেও নিরাপত্তা চেয়ে স্থানীয় লোকজন ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান। রবিবার রাতেও বাচ্চা চুরির গুজবে গণপিটুনিতে টালিগঞ্জের শ্রীমোহন লেনে আক্রান্ত হন এক তরুণী। সোমবার সেখানেও স্থানীয় লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ার বাচ্চা চুরি সংক্রান্ত সেই পোস্টটি দেখিয়েছেন। যেটি এ দিন দেখা গিয়েছে চৌবাগার বাসিন্দাদের মোবাইলেও। চৌবাগার মতোই সোমবার এলাকা থেকে শিশু নিখোঁজ হয়েছে বলে স্থানীয়দের একাংশ জানান। কিন্তু আদতে তার কোনও ভিত্তি নেই বলেই পুলিশ জানিয়েছে।

রাজ্য পুলিশের এডিজি(আইন, শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা এ দিন নবান্নে বলেন, ‘‘শিশু চুরির গুজব ঘিরে বিভিন্ন জায়গায় বিভ্রান্তি চলছে। পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছেও আবেদন করা হচ্ছে কোনও খবর কানে এলে আগে পুলিশকে জানান। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’’ ফলে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশও যখন বিষয়টি গুজব বলেই মনে করছে তখন শক্ত হাতে কেন তা ঠেকাতে পারছে না প্রশাসন? টালিগঞ্জের ওই ঘটনায় আক্রান্ত তরুণীকেই পুলিশ অপহরণের চেষ্টার মামলায় গ্রেফতার করেছে। যদিও সোমবার পুলিশই স্বীকার করেছে ওই তরুণীর মানসিক সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্রও হাতে এসেছে পুলিশের। এ দিন পুলিশের মামলার ভিত্তিতে আদালত তরুণীকে এক দিনের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। অথচ যারা তাকে পেটাল তাদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।

এ দিন চৌবাগায় গিয়ে শোনা যায়, রবিবার রাতে এলাকায় আগন্তুক সেই যুবকের সঙ্গে নাকি করাত, ছুরি-সহ নানান ধারাল অস্ত্র ছিল। শ্রীমোহন লেনে গিয়ে শোনা যায় আক্রান্ত তরুণী নাকি মাথার চুলের মধ্যে ব্লেড লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু তদন্তে উঠে আসেনি বলেই দাবি পুলিশের।

আবার এ হেন গুজবের আংশিক প্রভাব পড়তে দেখা গিয়েছে বিধাননগর সংযোজিত এলাকা পোলেনাইটে। সোমবার সেখানে ছেলেধরা সন্দেহে এক ভবঘুরে চেহারার ব্যক্তিকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ জানায়, পোলেনাইটে একটি প্রাইমারি স্কুলে ছুটির পরে খোঁজ মিলছিল না দুই পড়ুয়ার। পুলিশ জানায়, স্কুল লাগোয়া একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। তবে স্থানীয় যুবকদের তৎপরতায় ওই ব্যক্তিকে কেউ মারধর করতে পারেনি। পরে দু’টি বাচ্চারই খোঁজ মেলে।

পুলিশের একাংশের ধারণা, এই ধরনের গুজব সমাজের এমন শ্রেণির লোকজনের মধ্যে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে স্তরে লেখাপড়া, ভাবনাচিন্তা কম। যে স্তরে যে কোনও কিছুই খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। লালবাজারের পুলিশকর্তারা জানান, শিশু চুরির গুজবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শহরের সব থানাকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বত্র প্রচার, লিফলেটও বিলি করা হচ্ছে। এলাকায় পুলিশি টহলদারি বাড়াতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rumour গুজব
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE