Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
রাজা বসন্ত রায় রোড

জল-ছবিটা আজও পাল্টালো না

বাড়িটা রাজা বসন্ত রায় রোডে। বাড়ির ঠিকানা লেক রোড। কী করে এমন হয়? প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরেও সে রহস্য আমার কাছে রহস্যই থেকে গেল!

সাহেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫২
Share: Save:

বাড়িটা রাজা বসন্ত রায় রোডে। বাড়ির ঠিকানা লেক রোড। কী করে এমন হয়? প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরেও সে রহস্য আমার কাছে রহস্যই থেকে গেল!

সে যা-ই হোক, পাড়াটা আমার। লেক কালীবাড়ি, বিবেকানন্দ পার্ক, সাদার্ন অ্যাভিনিউ— সব একেবারে ঘিরে রয়েছে এই পাড়াকে। আমার ছোটবেলা, আমার বড় হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই তার একটু একটু করে বদলে যাওয়া। তবে হ্যাঁ, দু’একটা জিনিস বাদ দিলে এখনও এ পাড়ার খারাপ কিছু খুঁজে বার করতে পারিনি।

আমার বাবা ছিলেন আমুদে মানুষ। সবার সঙ্গে সাবলীল ভাবে মিশতে পারতেন। সে ক্ষমতাটার খানিক আমিও পেয়েছি। পাড়ার সকলের সঙ্গে মিশে, তাঁদের সুখ-দুঃখ-আনন্দের ভাগীদার হতে আমার ভালই লাগে। তাই ভালবাসাটাও পাই। বিপদে-আপদে যখনই প্রয়োজন হয়, সকলেই পাশে থাকে। তবে এ পাড়া এখনও মোটামুটি মিলেমিশেই দিন গুজরান করে। কিছু পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে। নতুন বাসিন্দারা এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগটা এখনও হয়তো ততটা নেই। তবে হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফেরার সময়ে দেখতাম পাড়ার দাদারা রকে বসে আড্ডা দিচ্ছে, খুব ইচ্ছে হতো ওদের সঙ্গে একটু গল্প করতে। লাজুক ছিলাম তো, সাহস করে উঠতাম না। আস্তে আস্তে ওরাই ডেকে নিল। আড্ডার নিয়মিত মুখ হয়ে উঠলাম আমিও। শুধু দাদারা কেন, বাবা-কাকা-জ্যাঠারাও তো পাড়ার রকে, মোড়ের চায়ের দোকানেই আড্ডা দিতেন। সেই ছবিটা পাল্টে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে। ব্যস্ততা বেড়েছে সকলেরই। জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে অলস সময়। রকে, দোকানে আগের মতো আড্ডা কই? কেউ থাকে না বললেই চলে।

এখনকার জীবনযাপনের ব্যস্ততা আর ইঁদুরদৌড়ই তো আরও একটা জিনিস চিরতরে মুছে দিল পাড়া থেকে। আমাদের ছোটবেলায় গলিতে আলো জ্বালিয়ে, নেট টাঙিয়ে জমজমাট ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। গলি থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই হতো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। দুটোতেই দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে। বিকেলগুলো আশ মিটিয়ে মাঠেঘাটে খেলা, সবার সঙ্গে মিশতে শেখা, বন্ধুত্ব— পাড়ার এই ছোট্ট ছোট্ট মজাগুলো এখনকার বাচ্চারা পেলই না। ভারী ব্যাগ কাঁধে শুধু দৌড়চ্ছেই, স্কুল থেকে কোচিং ক্লাস। ওদের খেলা, বন্ধুত্ব সবেরই ঠিকানা মোবাইল আর ট্যাব। বাবা-মায়েদের দোষ দেব? নাঃ, সেটাও বোধহয় ঠিক না। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে ওঁদেরই বা উপায় কী?

তবে এত ব্যস্ততাও পাড়ার একটা জিনিস বদলাতে পারেনি। দুর্গাপুজোর চেয়েও এ পাড়ার নিজস্ব উৎসব অন্নপূর্ণা পুজো। সে আবার একেবারে আমার পাশের বাড়িতেই। গোটা পাড়া তাতে হইচই করে জুটে যায়। ঢালাও খাওয়াদাওয়া, আমাদেরই কোমর বেঁধে পরিবেশনে নেমে পড়া, অসংখ্য লোকের আনাগোনা, মণ্ডপেই ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ, নাচতে নাচতে বিসর্জনে যাওয়া— সবটাই কিন্তু প্রায় একই রকম আছে। দুর্গাপুজোটা ঠিক পাড়ার নয়, একটু দূরের বালিগঞ্জ কালচারাল। সেখানেই যাই পুজোয়। সরস্বতী পুজোতেও এখনও মজা হয় যথেষ্টই। আর একটা জমজমাট পুজো হচ্ছে ‘দশমহাবিদ্যা কালী’পুজো। দারুণ রমরমা ছিল। ছোটবেলায় বোধহয় জাঁকজমক আরও মজাদার লাগে। এখনও ওই পুজোয় দারুণ জমজমাট আয়োজন হয়, কিন্তু চোখে লেগে আছে সেই ফেলে আসা দিনগুলো। এই উৎসবের দিনগুলোতেই অবশ্য আমার ছোটবেলার পাড়ার চেনা চেহারাটা ফিরে আসে। বছরের বাকি দিনগুলোয় যে চেহারাটা কে়ড়ে নেয় সময়ের অভাব।

এ পাড়ায় এমনিতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। পুলিশি টহল হয় নিয়মিত, সুরক্ষিত থাকে পাড়াটা। আগে রাস্তার আলোগুলো জ্বলত না, অন্ধকার থাকত। বছর দশেক হল আলোয় ঝলমল করে গোটা পাড়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে, আলোয় সেজে ভোল পাল্টেছে বিবেকানন্দ পার্কেরও। জঞ্জাল সাফাইও ঠিক মতোই হয়। তবে গলি থেকে বেরিয়ে ব্যাঙ্কের পাশের ভ্যাটটা আর একটু পরিষ্কার থাকলে ভাল হতো। তবে সমস্যা বলতে জল জমা। একটু বৃষ্টি হল কি না হল, আমার গলি ভরা জল। বাড়ির সিঁড়ির দুটো ধাপ ডুবে যাওয়া। রাস্তাটা উঁচু করা হয়েছে। তবু জল জমার ছবিটা এত বছরেও পাল্টানো যায়নি। ছোটবেলায় ওই জল ভেঙে বন্ধুদের সঙ্গে ছপছপ করে হাঁটতাম। কাগজের নৌকো ভাসানোটাও ছিল ভারী মজার। আর এখন কাদাজল দেখলে বিরক্তি হয়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসলে সারল্যটা হারিয়ে যায় তো! সেই দৃষ্টিও নেই যা দিয়ে মলিন জলে অমলিন আনন্দ পাব।

পুরনো বাড়িগুলো ভাঙছে। সঙ্গে চরিত্র বদলাচ্ছে আমার পাড়া। কফিশপ, পাব, দুটো রেস্তোরাঁ, একটা জিম— পাড়ার চেহারা তো বদলেছেই। বাইরের লোকেদের, তরুণ প্রজন্মের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় চারপাশটা এখন বেশ হ্যাপেনিং! পাড়ায় জিম হওয়ায় আশপাশের মানুষও এখন বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠছেন। তবে যতই যা বদলে যাক, সবই ‘কসমেটিক চেঞ্জেস’। অন্তর-আত্মা এখনও সেই চিরকালীন সারল্যে ভরপুর।

ছোটবেলায় বাবা যখন পাড়ার মোড়ে আড্ডা দিতেন, আমিও হয়তো আড্ডা মারছি কোথাও। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বাড়ির দিকে রওনা হতেন। আজও কখনও যখন আমি আড্ডা দিই ওই ভাবে, চোখটা অজান্তেই বাবাকে খোঁজে। শুধু তো পাড়ার স্মৃতি নয়, পাড়া জুড়ে বাবার স্মৃতিটাও যে ছড়িয়ে আছে।

লেখক বিশিষ্ট অভিনেতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE