Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাচ্চারা অক্ষত, শুধু নেই স্কুলবাসের ড্রাইভার কাকু

দুর্ঘটনার পরে সেই স্কুলবাসের সামনের অংশ। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র

দুর্ঘটনার পরে সেই স্কুলবাসের সামনের অংশ। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ০৭:৩৫
Share: Save:

বাচ্চাদের ভালবাসতেন তিনি। সেই কারণেই বেছে নিয়েছিলেন স্কুলবাস চালানোর কাজ। প্রতিদিন বাস চালিয়ে কচিকাঁচাদের স্কুলে দিয়ে আসা-নিয়ে যাওয়াতেই ছিল তাঁর আনন্দ।

শুক্রবারও রুটিন মাফিক সাতসকালে স্কুলবাস নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বনাথ সামন্ত (৫০)। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। অন্য দিনের মতো সল্টলেক, লেকটাউন ও বাইপাস থেকে লরেটো স্কুলের ছাত্রীদের তুলে নিয়ে নিশ্চিন্তে যাচ্ছিলেন পার্ক সার্কাসের দিকে। তপসিয়া মোড়ের কাছে আচমকাই সামনে এসে পড়ে পথচলতি কচিকাঁচার দল। তাদের পিঠেও স্কুলব্যাগ। স্কুলের পথে রাস্তা পেরোচ্ছিল তারা। তাদের বাঁচাতেই ডান দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দেন বিশ্বনাথবাবু। সোজা গিয়ে ধাক্কা মারেন উড়ালপুলের নীচের স্তম্ভে। বাসের যেখানটায় চালকের কেবিন, সেখানটাই স্তম্ভে লেগে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। হাসপাতালের পথেই মারা যান বাচ্চাদের ‘ড্রাইভার কাকু’।

বাসে থাকা বাচ্চারা অল্পবিস্তর চোট পেলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সকলেই। হাসপাতালে কয়েক জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এক জনকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। পরে তাদের কানে যখন ‘ড্রাইভার কাকু’র মৃত্যুর খবর পৌঁছয়, কান্নায় ভেঙে পড়ে সকলেই। লেকটাউন-যশোহর রোডের বাসিন্দা রশ্মি সুরানা এ দিন বলেন, ‘‘ওই চালকের জন্যই আজ আমাদের বাচ্চারা রক্ষা পেয়েছে। কত সময়ে তো শুনেছি, দুর্ঘটনার মুহূর্তে চালক আগে বাস থেকে লাফিয়ে পালান। উনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন বাচ্চাদের বাঁচানোর।’’ রশ্মির দুই মেয়ে মিনাল ও প্রাঞ্জেলও ছিল ওই বাসে। মিনাল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আর প্রাঞ্জেল পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে।

লরেটো স্কুলের অধ্যক্ষা সিস্টার নির্মলাও এ দিন বলেন, ‘‘যে ভাবে গাড়িচালক নিজের প্রাণ দিয়ে বাচ্চাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর জন্য আমরা কৃত়জ্ঞ।’’ এ দিন এই কৃতজ্ঞতার ছবি দেখা গিয়েছে অভিভাবকদের সকলেরই চোখে-মুখে। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সানিয়া সর্দারের বাবা সন্দীপ সর্দার বলেন, ‘‘আমি মেয়ের কাছে খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যাই। দেখেই বুঝতে পারি, গাড়িচালক কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করেই ওই দুর্ঘটনার মুখে পড়েছেন। রাস্তার ধারে স্তম্ভে ধাক্কা মেরে তিনি বাসের প্রায় তিরিশ জন ছাত্রীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’’

যাঁর মৃত্যুর খবরে উতলা ছাত্রী ও অভিভাবকেরা, তাঁর বিরুদ্ধে কখনওই বাজে ব্যবহার বা বাজে ভাবে গাড়ি চালানোর অভিযোগ ওঠেনি। পুলিশের একাংশ মনে করছে, দুর্ঘটনায় মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরেও বাচ্চাদের অক্ষত রাখতেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথবাবু। তাই নিজের কেবিনের অংশটিই স্তম্ভের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে বুঝেও তিনি কোনও ভাবে স্টিয়ারিং অন্য দিকে ঘোরাননি। ফলে তাঁর নিজের জীবন চলে গেলেও বাসের ভিতরে থাকা পড়ুয়াদেরও কোনও ক্ষতি হয়নি।

বিশ্বনাথ সামন্ত

শুক্রবার দুপুরে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে যাঁকে ঘন ঘন আঁচলে চোখ মুছতে দেখা গেল, তিনি বিশ্বনাথবাবুর স্ত্রী বাণীদেবী। বুজে আসা গলায় বলেন, ‘‘অনেকেই তো দুর্ঘটনা হলে আগে নিজেকে বাঁচাতে লাফ দেয়। উনি এ সব কিছুই করলেন না। বাচ্চাদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই চলে গেলেন।’’ তিনিই জানালেন, এর আগে যাত্রিবাহী বাস চালাতেন বিশ্বনাথবাবু। গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই স্কুলবাস চালানোর কাজ করছিলেন। প্রতিদিন ভোরে বেলেঘাটার বাড়ি থেকে সাইকেলে সল্টলেকে যেতেন। সেখানকার একটি গ্যারাজ থেকে স্কুলবাস নিয়ে ছাত্রীদের তুলতে তুলতে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। শুক্রবার সে পথেই হয় দুর্ঘটনা। পাশের বাড়ি থেকে হঠাৎই ফোন পান বাণীদেবী। বাসমালিকের ফোন পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছলে জানতে পারেন বিশ্বনাথবাবুর মৃত্যুর খবর। বিশ্বনাথবাবুর দুই ছেলে এবং পুত্রবধূও ছিলেন হাসপাতালে। পুত্রবধূ বেবি সামন্ত বলেন, ‘‘বাচ্চাদের প্রতি সব সময়ে খুবই যত্ন নিতেন। সেই কারণে বাচ্চাদের অভিভাবকেরাও ভরসা করতেন ওঁকে।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, শুক্রবার সকাল সাতটা নাগাদ যখন তপসিয়া রোড দিয়ে বাসটি যাচ্ছিল, তখন তার মধ্যে ছিল মিডলটন রো-এর লরেটো স্কুলের জনা তিরিশ পড়ুয়া। কেউ কেজি-তে পড়ে, কেউ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। দুর্ঘটনার পরেই পুলিশ এসে রক্তাক্ত অবস্থায় বিশ্বনাথবাবুকে নিয়ে যায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। আহত খালাসি শম্ভু সিংহকে ভর্তি করা হয় ওই হাসপাতালেই। এ দিকে বাসের ভিতরে আচমকা ঝাঁকুনিতে ছাত্রীদের অনেকেরই তখন ছড়ে গিয়েছে হাত-পা, কারও ফুলে গিয়েছে মাথা। দু’জনের মাথা সামান্য ফেটে গিয়ে রক্তও পড়ছে। তাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাস থেকে নামিয়ে আনা হয়। স্থানীয় মানুষ এবং পুলিশ একটি যাত্রিবাহী বাসকে থামায়। সেই বাসের যাত্রীদের নামিয়ে আহত পড়ুয়াদের তোলা হয় বাসে। ওই বাসে করে তাদেরও নিয়ে যাওয়া হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। হাসপাতালে যান স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেখানে চিকিত্সার পরে পড়ুয়াদের ফের ওই বাসে করেই ফিরিয়ে আনা হয় স্কুলে। স্কুল থেকে অভিভাবকেরা তাদের নিয়ে যান।

এই স্কুলবাসটি লরেটো স্কুলের নিজস্ব নয়। অভিভাবকেরাই ঠিক করেছিলেন বাসটি। স্কুলের অধ্যক্ষা সিস্টার নির্মলা জানিয়েছেন, আহত প্রতি পড়ুয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা করবেন তাঁরা। সাময়িক যে আতঙ্কে রয়েছে বাচ্চারা, তা থেকে বার করে আনার জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। সিস্টার নির্মলা বলেন, ‘‘যে ভাবে পুলিশ তত্পর হয়ে বাচ্চাদের ওই অল্প সময়ের মধ্যে উদ্ধার করেছে, তা প্রশংসনীয়।’’

ঠিক কী ভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটল, তা জানার জন্য ওই রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

accident driver death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE