Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কেউ নেই যার, পাঠশালা পাশে আছে তার

কখনও স্টেশনে, কখনও রাস্তায় ঘুরে বেড়াত দুই ভাই। কতই বা বয়স হবে, মেরেকেটে চার-ছয়! কেউ দয়া করে কিছু দিলে খাবার জুটত, তাও অবশ্য আধপেটা। খিদে চেপে রেখেই রাত কেটে যেত সিঙ্গুর স্টেশনে।

পাঠ: বালির শ্রমজীবী পাঠশালায় পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

পাঠ: বালির শ্রমজীবী পাঠশালায় পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৪৪
Share: Save:

কখনও স্টেশনে, কখনও রাস্তায় ঘুরে বেড়াত দুই ভাই। কতই বা বয়স হবে, মেরেকেটে চার-ছয়! কেউ দয়া করে কিছু দিলে খাবার জুটত, তাও অবশ্য আধপেটা। খিদে চেপে রেখেই রাত কেটে যেত সিঙ্গুর স্টেশনে।

মা মারা যাওয়ার পরে এমন ভাবেই দিন কাটছিল সিঙ্গুরের সুরজিৎ আর প্রসেনজিতের। কারণ, বাবা তো তাদের ছেড়ে কবেই চলে গিয়েছেন। কিন্তু ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’-এর মতো বছর দেড়েক আগে কয়েক জন মানুষের কাছাকাছি এসেছিল দুই খুদে। সেই মানুষদের সহযোগিতাতেই এখন আর রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয় না দুই ভাইকে। মাথার উপরে ছাদ জুটেছে ওদের। জামাকাপড়, দু’বেলা ভাত-ডালের সংস্থান হয়েছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে পড়াশোনাও।

শুধু সিঙ্গুরের দুই ভাই-ই নয়, আর্থিক কারণে পড়াশোনা করতে না পারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ছেলেমেয়েদের ঠাঁই দিয়েছে বালির শ্রমজীবী পাঠশালা। বালি দেওয়ানগাজি রোডে প্রায় ২ বিঘা জমিতে সেই পাঠশালা গড়ছে বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতি। কয়েক বছর আগে নিজেদের কোটি টাকার সম্পত্তি শ্রমজীবী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন বালির বাসিন্দা তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজ্যের প্রথম ডিলিট পাওয়া মহিলা সবিতা মিশ্র ও তাঁর বোন সরস্বতী মিশ্র, সাবিত্রী বিশ্বাস।

শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সমিতির কার্যকরী সভাপতি ফণিগোপাল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সম্পত্তি আমাদের দেওয়ার শর্তই ছিল, মানুষের চিকি‌ৎসার পাশাপাশি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। সব মিলিয়ে এই পাঠশালা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়।’’ কিন্তু পাঠশালা নাম কেন? ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েরাই এখানে আসছে। আর এই নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে মাটির গন্ধ।’’ বললেন ফণিগোপালবাবু। তিনি জানান, এত দিন সেটা হত হাসপাতালের শ্রীরামপুর শাখায়। স্কুল ছুট কিংবা অভাবের জন্য মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে আর পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারা ছেলেমেয়েরা শ্রীরামপুরে এসে শিখেছে পড়াশোনা, মিলেছে স্বাস্থ্য সহায়ক হওয়ার প্রশিক্ষণ। তাতে সহযোগিতা করেছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও চিকিৎসকেরা।

হাসপাতালের সহ-সম্পাদক গৌতম সরকার জানান, এত দিন একটু বড় বয়সের ছেলে-মেয়েদের রাখা হত। কিন্তু এখন একেবারে ছোট ছেলেমেয়েদের, যাদের কেউ দেখার নেই, তাদেরও নিয়ে আসা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘ছোট থেকে মানুষ করলে তার দায়িত্ববোধ অনেক বেশি হয়। যদিও এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই যে পড়াশোনা শিখে এই হাসপাতালেই থাকতে হবে। তবু ভবিষ্যতে শ্রমজীবী হাসপাতালকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই আগামী প্রজন্মকে তৈরি করার একটা প্রচেষ্টা চলছে।’’ বালির ওই পাঠশালাতেই থাকে বাঁকুড়ার শিমলিপালের জ্যোৎস্না মাঝি। বাবা অন্যের জমিতে কাজ করেন। পাঁচ বোন, এক ভাইয়ের সংসারে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে আর এগোতে পারেনি জ্যোৎস্না। শ্রমজীবী থেকে মাধ্যমিক পাশ করে এখন স্বাস্থ্য সহায়কের কাজ শিখছে। রয়েছে তার ভাই ফকিরও।

গৌতমবাবু জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় ক্লাব-সংগঠনের সহযোগিতায় খেলাধূলারও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন জৌগ্রামের দিলীপ হেমব্রম এখন মাধ্যমিকের পড়াশোনার পাশাপাশি বালির অ্যাথলেটিক ক্লাব থেকে ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আবার স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে একটি আদিবাসী গ্রামের তরুণী অপর্ণা ও তাঁর ছোট্ট সন্তানের জায়গা হয়েছে এই পাঠশালায়। স্বাস্থ্য সহায়কের পাঠ নিয়ে তিনিও এখন হাসপাতালে যুক্ত বলেই জানান সম্পাদক তথা চিকিৎসক অনিল সাহা।

অনিলবাবু জানান, পশ্চিমবঙ্গ সোসাইটি ফর স্কিল ডেভেলপমেন্ট-এর ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পে জেনারেল ডিউটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, কার্ডিয়াক কেয়ার টেকনিশিয়ান, ডায়ালিসিস টেকনিশিয়ান ও ল্যাবরেটরি সহায়কের কোর্সের জন্য আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ হলে ওই প্রশিক্ষণ নেওয়া যাবে। বাইরের ছেলেমেয়েরাও এই প্রশিক্ষণ পাবেন বিনামূল্যে।’’ তিনি আরও জানান, রাজ্যের নার্সিং কাউন্সিলের কাছেও আবেদন করা হয়েছে নার্সিং প্রশিক্ষণের জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

School Children Belur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE