Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘টাকার দাবি না মেটালে খুব কষ্ট দেবে’

নারায়ণপুরের বাসিন্দা সাদ্দাম হুসেন বললেন, ‘‘যাদের সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না, তারাই বিচারাধীন বন্দিদের স্বাচ্ছন্দ্যের চাবিকাঠি। প্রতিদিন তিনটে বিড়ি দিলে বাসন ধুয়ে দেবে, বেডিং করে দেবে। আমার ভাইয়ের তেরোখানা কম্বল দিয়ে বেডিং করেছিল। অনেকে অন্য বন্দিদের ফরমাশ খেটে বেল বন্ডের টাকা জোগাড় করেন!’’

দমদম সংশোধনাগারের বাইরে বন্দিদের পরিজনেদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র

দমদম সংশোধনাগারের বাইরে বন্দিদের পরিজনেদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৮ ০৩:১৬
Share: Save:

সাক্ষাতের জন্য জেল চত্বরে ঢোকার আগে পরিজনদের বসার জন্য দমদমে একটি প্রতীক্ষালয় আছে। সেখানে বসে নারায়ণপুরের বাসিন্দা সাদ্দাম হুসেন বললেন, ‘‘যাদের সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসে না, তারাই বিচারাধীন বন্দিদের স্বাচ্ছন্দ্যের চাবিকাঠি। প্রতিদিন তিনটে বিড়ি দিলে বাসন ধুয়ে দেবে, বেডিং করে দেবে। আমার ভাইয়ের তেরোখানা কম্বল দিয়ে বেডিং করেছিল। অনেকে অন্য বন্দিদের ফরমাশ খেটে বেল বন্ডের টাকা জোগাড় করেন!’’

পরিজনদের দাবি, কুপনের বিনিময়ে স্বাচ্ছন্দ্যের স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা। জেলের পরিভাষায় যাঁদের পোশাকি নাম ‘মেড’। তিন মাস আগে কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার থেকে মুক্ত হওয়া এক বন্দি তো মেডদের কথা বলতে গিয়ে জেলের অন্দরমহলের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘সেন্ট্রাল জেল ৫২ বিঘার। তিনটে বাড়ির প্রতিটিতে কুড়ি জন করে বন্দি থাকে। প্রথম বাড়ি সাজাপ্রাপ্তদের। দু’নম্বর বাড়িতে বিচারাধীন বন্দিরা। তিন নম্বরে মেডিক্যাল এবং বাংলাদেশিরা। জেলের এমন কোনও দাদা-ভাই নেই, যে আমাকে চেনে না। মেডদের টাকা দিলে পাখার তলায় বেড পাবেন। তার জন্য ১০০-২০০, যার কাছে যেমন পায় নেয়। অন্য সেটিং-ও সব হয়ে যাবে। আগে মেডরা চাপ দিত। এখন প্রতিটি হলঘরের দেওয়ালে লেখা আছে, মেডরা যদি চাপ দেয়, তা হলে তা জানাতে। অভিযোগ পেলে কিন্তু মেডদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’’

আলিপুরে কিন্তু অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে সদ্য জামিনে মুক্ত এক যুবকের। তাঁর কথায়, ‘‘যার যেমন কেস, তার কাছে তেমন টাকা দাবি করে। টাকার দাবি না মেটালে খুব কষ্ট দেবে। সকাল পাঁচটায় উঠিয়ে খাটাবে। খাবারের লাইনে দাঁড়াতেই দেবে না। ১৭ দিন ছিলাম। কী কষ্ট হয়েছে, বোঝাতে পারব না।’’

এরই মধ্যে সেপাই একটার পর একটা নাম ডাকতে থাকলেন। এই ডাকের অপেক্ষায় কোলের শিশুকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে বসে রয়েছেন আসিমা বিবি, জ্যোৎস্না হালদারেরা। যাঁদের কথোপকথনে অনেক গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আলিপুর-দমদম-প্রেসিডেন্সি মিলেমিশে একাকার।

দমদমের প্রতীক্ষালয়ে বছর পঁচিশের এক তরুণের কথায়, ‘‘কিছু ক্ষণ আগে আমার পাশে এক বন্দির স্ত্রী বসেছিলেন। তিনি আর এক মহিলাকে বলছিলেন, প্রতি সপ্তাহে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সময়ে মেমরি কার্ডে পর্নোগ্রাফি ভরে আনেন। জেলে থাকার জ্বালা অনেক। এখানে না এলে বুঝবেন না!’’

দমদমের সংশোধনাগার প্রসঙ্গে কারা দফতরের এক অধিকর্তা বলেন, ‘‘জেলের ভিতরে মোবাইলের ব্যবহার বন্ধ করতে সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি বড় রকমের তল্লাশি চালিয়ে অনেক মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। তাতেই কিন্তু পুরো বিষয়টি থেমে থাকেনি। স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি বারাসত আদালতে সংশ্লিষ্ট বন্দির বিরুদ্ধে মামলা রুজু পর্যন্ত করা হয়েছে। জেলের ভিতরে মোবাইলের ব্যবহার সারা পৃথিবী জুড়েই একটা সমস্যা। নেশার সামগ্রী জেলে বিশেষ মেলে না। সেই কারণেই এত দাম!’’

নেশাদ্রব্যের প্রবেশ রুখতে জেল কর্তৃপক্ষ যে সক্রিয়, তা বোঝাতে কারা দফতরের আর এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘সম্প্রতি দমদমে বাইরে থেকে আড়াই লিটার মদের বোতল, কেজিখানেক গাঁজা এবং মাদকের পাতা জেলের ভিতরে কেউ বা কারা ছুড়ে দিয়েছিল। নিশ্চয়ই আগে থেকে বিষয়টি ঠিক করা ছিল। এই ঘটনায় স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ফলে শুধু ফটক দিয়েই নেশার সামগ্রী ঢুকছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। তবে যে পথেই ঢুকুক, তা বন্ধ করতে আমরা তৎপর।’’

প্রেসিডেন্সি প্রসঙ্গে কারা দফতরের এক অধিকর্তা বলেন, ‘‘মোবাইল ও নেশাদ্রব্য পুরোপুরি বন্ধ করাই আমাদের লক্ষ্য। চেষ্টা করেও অনেক সময়ে তা সম্ভব হচ্ছে না। জুতোর সোলের মধ্যে মোবাইল ঢুকিয়ে সোল আটকে দিব্যি ঢুকে যাচ্ছে। বাইরে থেকে পোঁটলায় নেশার জিনিস ভরে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ভিতরে যাঁরা আছেন, তাঁরা তো কেউ সাধু নন। তাঁদের ফন্দির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মোবাইল ধরতে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। এক সময়ে সেল থেকে টাকা উদ্ধার হত। এখন এক বন্দির পরিজন অন্য বন্দির পরিজনের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। কাজেই বাইরে থেকে বিষয়গুলি যত সহজ মনে হয়, তা কিন্তু নয়।’’

জেলের ভিতরে ‘সেটিং’ প্রসঙ্গে মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসের সুরেই কারা দফতরের ডিজি (ওএসডি) অরুণ গুপ্ত বলেন, ‘‘যা বলা হচ্ছে, তা যে একেবারে মিথ্যা, সে কথা বলছি না। আবার জেল থেকে বেরোনো সকলেই সত্যি কথা বলছেন, এমনটাও নয়। জেলের ভিতরে মোবাইলের ব্যবহার নিয়ে কারা দফতর উদ্বিগ্ন বলেই তো নতুন আইন পাশ হয়েছে। এই আইন চালু হলে মোবাইল উদ্ধারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আলাদা করে তিন বছরের সাজা খাটতে হবে। জেলে মোবাইল ঢোকাতে যারা সাহায্য করবে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নতুন আইনে রয়েছে। আশা করছি, শাস্তির ভয়ে মোবাইল ব্যবহারের প্রবণতা অনেকটাই কমবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE