Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অত্যাচারের বহু গল্প লুকিয়ে রাখে পরিবারই

মনোবিদেরা বলেন, সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে মা-বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্ব ঠিক কতটা? পাশের ঘরে আগুন লেগে দগ্ধ হচ্ছেন বৃদ্ধ। তা টেরও পেলেন না ঘুমন্ত ছেলে-বৌমা! প্রতিবেশীদের থেকে খবর পেয়ে দরজা ভেঙে ঢোকে পুলিশ।

জয়তী রাহা
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫৫
Share: Save:

আঁতিপাতি করে খুঁজলেও ‘সবজান্তা’ গুগল কিন্তু কোনও তথ্য দিতে পারবে না। কারণ খানিকটা লোকলজ্জা, খানিকটা স্নেহের বশে ক্ষমা করে দেওয়ায় পরিবারের কুলুঙ্গিতেই তোলা থাকে সেই সব গোপন তথ্য। আর এই প্রবণতার জন্যই অত্যাচারিত মা-বাবার সংখ্যা বাড়ছে সমাজে। এমনটাই বলছেন অধিকাংশ মনোবিদ এবং বয়স্কদের নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন। তাঁদের দাবি, শিশু নির্যাতন নিয়ে যতটা সরব এ সমাজ, ততটা কিন্তু মা-বাবার উপরে অত্যাচারের ক্ষেত্রে নয়। ফলে গবেষণাধর্মী কোনও কাজও করা যায় না এ নিয়ে। খুঁজলেও মেলে না কোনও পরিসংখ্যান।

অথচ একের পর এক ঘটনায় শঙ্কিত অভিভাবকেরা। প্রায় প্রতিদিন সংবাদের শিরোনামে উঠে আসা সেই খবরের তালিকায় রয়েছে, মোটরবাইকের টাকা চেয়ে মা-বাবাকে মারধর করে জেলে যাচ্ছেন ফিটনেস ট্রেনার যুবক। কোথাও বিপত্নীক বৃদ্ধকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর সরকারি কর্মী পুত্র এবং শিক্ষিকা বৌমা। কম বয়সে স্বামী ছেড়ে যাওয়া পরে স্ত্রী কোলে-পিঠে মানুষ করলেন তাঁদের সন্তানকে, কষ্ট করে মাথা গোঁজার আস্তানা বানালেন। অথচ সেই সন্তানই বড় হয়ে সবটা নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করেন। এ জন্য মায়ের মাথা ফাটাতেও হাত কাঁপে না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঘরে বন্ধ করে সন্তানের সপরিবার বেড়াতে যাওয়ার ঘটনাও সামনে আসছে সম্প্রতি।

আরও পড়ুন: মায়ের কোলে ফেরাল পুলিশ

মনোবিদেরা বলেন, সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে মা-বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্ব ঠিক কতটা? পাশের ঘরে আগুন লেগে দগ্ধ হচ্ছেন বৃদ্ধ। তা টেরও পেলেন না ঘুমন্ত ছেলে-বৌমা! প্রতিবেশীদের থেকে খবর পেয়ে দরজা ভেঙে ঢোকে পুলিশ। তখনও ঘুমোচ্ছেন ছেলে!

যদিও টুকরো এই ছবিগুলির প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গিয়েছিল বহু দিন আগেই। সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র বলছেন, এর মূলে রয়েছে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন। তিনি জানান, এর জমিটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যৌথ পরিবার ভাঙার পর থেকে। পরিবারের সদস্যদের আর বড়দের কাছে জবাবদিহি করতে হল না কোনও বিষয়ে। ধীরে ধীরে মূল্যবোধ, কর্তব্য, দায়িত্ব থেকে সরে আসতে লাগলেন একাংশ। এরই মধ্যে নব্বইয়ের দশকের মুক্ত অর্থনীতির হাওয়ায় দ্রুত বদলাল সমাজ।
সেই সঙ্গে অনিশ্চিত বাজারকে সামাল দিতে খুব সহজেই নষ্ট হতে লাগল ধৈর্য। অভিজিৎবাবুর মতে, ‘‘এখন একটাই টেন্স— ‘নাও’। যা চাই তা এই মুহূর্তেই পেতে হবে। ভবিষ্যতের আশায় কিছু মর্টগেজ রাখতে রাজি নন তাঁরা।’’

জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীও মনে করেন যৌথ পরিবারতন্ত্র ভেঙে যাওয়া এ ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি তাঁর পরামর্শ, অভিযুক্ত সন্তানের অতীত
ঘাঁটলে হয়তো দেখা যাবে, সেই সন্তান শৈশবে স্বাভাবিক ভেবে বেড়ে ওঠেননি। মা-বাবার অবহেলা অথবা অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপে তাঁর ক্ষোভ জন্মেছিল। বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অত্যাচারের মাধ্যমে। এ কথা মানছেন মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব। তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘সব সময়ে যে মা-বাবার ভুলের খেসারত বার্ধক্যে মিলছে এমনটা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সন্তান নিজস্ব ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ থেকেও এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন। তাঁর পরামর্শ, সন্তানের ব্যবহার আর পাঁচটি বাচ্চার থেকে আলাদা কি না, তা লক্ষ রাখতে। কিছু পরিবর্তন বুঝলে সজাগ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

বিশেষ়জ্ঞদের পরামর্শ, এমন প্রবণতা রুখতে সন্তানের শৈশবেই সচেতন হোন মা-বাবা। নিয়মিত চারাগাছটির যত্ন নিন। হাজার ব্যস্ততাতেও পরিবারকে সময় দিন। কারণ বার্ধক্যে আপনাকে ফিরে আসতে হবে সন্তানের কাছেই। নিজের পূরণ না হওয়া স্বপ্ন সন্তানের উপরে চাপিয়ে দেবেন না। অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপে ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে। সন্তানের প্রকৃত বন্ধু হোন, যাতে তাকে সহজ ভাষায় ভালমন্দ বুঝিয়ে দেওয়া যায়।

শত ঝড়ঝঞ্ঝায় আপনার প্রিয় মানুষটির মাথা উঁচু রাখার শিক্ষাটা শুরু হোক তাই শৈশবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elderly People Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE