Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

তিন দিন বৃদ্ধা মাকে ঘরবন্দি করে জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্নে গেল ছেলে-বৌমা!

দক্ষিণ রবীন্দ্রনগরের ক্ষুদিরাম সরণিতে তিন কাঠা জমির উপরে নিজের বাড়ি ছিল বৃদ্ধা শোভারানি দাসের।

অমানবিক: হাসপাতালে শোভারানি দাস।

অমানবিক: হাসপাতালে শোভারানি দাস।

সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৮ ০২:৩৬
Share: Save:

খাবার বলতে এক বোতল জল আর চারখানা বিস্কুট। দরজা-জানলা যে ভাবে বন্ধ, তাতে কারও দৃষ্টি তো দূর, আলো-বাতাসও ঢুকতে পারবে না। আশি বছরের বৃদ্ধা মাকে তিন দিনের জন্য ওই অবস্থায় রেখে জামাইষষ্ঠী নেমন্তন্নে কালিকাপুরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন ছেলে। সঙ্গে বৌমা। বুধবার রাতে বৃদ্ধাকে উদ্ধার করার পরে সব শুনে স্তম্ভিত দমদমের বেদিয়াপাড়ার বাসিন্দারা।

দক্ষিণ রবীন্দ্রনগরের ক্ষুদিরাম সরণিতে তিন কাঠা জমির উপরে নিজের বাড়ি ছিল বৃদ্ধা শোভারানি দাসের। ওই বাড়িতে প্রোমোটিং হওয়ায় ছোট ছেলে ভবনাথ দাস ও বৌমা শ্যামলী দাসের সঙ্গে বেদিয়াপাড়ার আর এন ঠাকুর রোডের একটি বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকেন তিনি। প্রতিবেশী এক মহিলা জানান, গত তিন দিন ধরে মাঝেমধ্যেই দরজা-জানলায় ধাক্কা মারার আওয়াজ পাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই আওয়াজ যে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা করছেন, তা প্রথমে বুঝতে পারেননি কেউ। বুঝবেনই বা কী করে! অভিযোগ, বাড়িতে মায়ের অস্তিত্ব যাতে পাড়া-প্রতিবেশী টের না পায়, তার জন্য বন্দোবস্তের কোনও কসুর রাখেননি ছেলে-বৌমা। সদর দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝোলানো। শোভারানি যাতে জানলা খুলতে না পারেন, তার জন্য ভিতরের একটি জানলা ছিটকিনির পাশাপাশি চেন-তালা দিয়ে লাগানো ছিল। আর একটি জানলা কাঠের বিম দিয়ে সিল করে দিয়েছিলেন পেশায় অটোচালক ভবনাথ।

এই পরিস্থিতিতে বুধবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বৃদ্ধার কান্নার আওয়াজ শুনে বিচলিত হয়ে পড়েন প্রতিবেশীরা। চেন-তালা লাগানো জানলার পাল্লা কোনও মতে সরিয়ে ঘরের ভিতরে বৃদ্ধাকে তাঁরা দেখতে পান। এর পরে তাঁরাই দরজার তালা ভেঙে শোভারানিকে উদ্ধার করেন। রাত ১০টা নাগাদ দমদম পুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে।

এমন অবস্থাতেই উদ্ধার করা হয় তাঁকে।

বৃহস্পতিবার হাসপাতালের বিছানায় বসে বৃদ্ধা বলেন, ‘‘যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিল, ছেলেকে বললাম, চার দিন ধরে ভাত খাইনি, একটু ভাত দিয়ে যা। ভাত ছিল না। তখন বললাম একটু মুড়ি দিতে। চোখে তো দেখতে পাই না। একটু পরে বুঝলাম, মুড়িও নেই। শুধু এক বোতল জল আর চারটে বিস্কুট দিয়ে গিয়েছে।’’ স্থানীয় বাসিন্দা শিখা রায় বললেন, ‘‘যাতে শৌচাগারে যেতে না হয়, তার জন্য সোম ও মঙ্গলবারের ওই অস্বাভাবিক গরমেও মাত্র এক বোতল জল দিয়ে গিয়েছিল। নিজের মায়ের সঙ্গে কেউ এমন ব্যবহারও করতে পারে!’’

স্থানীয় বাসিন্দাদের রোষের মুখে ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন ভব ও তাঁর স্ত্রী। তবে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে যুক্তি দিতে ছাড়েননি তাঁরা। ছেলের বক্তব্য, ‘‘জানলা খোলা থাকলে মা মলত্যাগ করে কাগজে মুড়ে বাইরে ছোড়েন। তাই মাকে নিয়ে প্রতিবেশীরা যাতে অসুবিধায় না পড়েন, সেই জন্যই ওই ভাবে রেখে গিয়েছিলাম।’’ বৃদ্ধা মাকে দেখাশোনার জন্য লোকও তো রাখা যেত? বৌমার জবাব, ‘‘আমাদের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই।’’

ছোট ছেলে ভবনাথ। নিজস্ব চিত্র

যদিও তা মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, তিন কাঠা জমির উপরে প্রোমোটিং হচ্ছে। টাকার তো অভাব হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে শোভারানির দুই ছেলে দায়িত্বের ভার একে অপরের কোর্টে ঠেলেছেন। ছোট ছেলের যুক্তি, পাঁচতলা বাড়ি উঠলেও তাঁরা মাকে তাঁর ভাগের টাকা দেননি। কারণ, মায়ের দায়িত্ব তো তাঁদেরই নিতে হবে। তাঁর দাবি, বাড়ির প্রোমোটিং সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় দেখছেন দাদা জগন্নাথ দাস। সেই দাদার বক্তব্য, ‘‘মায়ের দায়িত্ব নেবে বলেই তো ভাই তার ভাগে ১০০ বর্গফুট জায়গা বেশি পেয়েছে। আমি বাবার চিকিৎসা ও দেখাশোনার ভার নিয়েছিলাম।’’ তাঁর অভিযোগ, মায়ের খোঁজ নিতে গেলে ভবনাথের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দিতেন না। উল্টে মাকে দেখতে যাওয়ার জন্য শুরু হয়ে যেত অশান্তি।

দুই ছেলে যখন মায়ের দায়িত্ব কার বেশি, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত, তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মা বলছেন, ‘‘আমার ছেলের কোনও দোষ নেই। ভালই যত্নআত্তি করে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sovarani Das Elderly Son
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE