নিজেদের সৃষ্টির সামনে সুরজ ও রাজা। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। নিজস্ব চিত্র
ফুটপাতে জন্ম ওদের। ফুটপাতেই সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই। মাঝেরহাট সেতু বিপর্যয় অবশ্য বাদ সেধেছে সেটুকু নিরাপত্তাতেও। রাজা ও সুরজকে গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচ থেকে পাশের ফুটপাতে সরে যেতে হয়েছে তল্পিতল্পা নিয়ে। তবে তাতে ছেদ পডেনি ওদের সবচেয়ে প্রিয় কাজে— সাদা কাগজে রঙের আঁকিবুকি। আঁকতে বসার সময়টা ওদের কাছে উড়ালপুলের তলা থেকে মাঝেমধ্যে চোখে পড়া চিলতে নীল আকাশটুকুর মতোই মূল্যবান। ভ্যান টানা বা ধূপকাঠি বিক্রির ফাঁকে অবসরটুকু তোলা থাকে এর জন্যই।
ওদের মতো আরও নয় পথশিশু ও অনাথ আশ্রমের আবাসিকদের কাজ নিয়ে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে চলছে প্রদর্শনী ‘আমরা আঁকি আনন্দে’। চলবে আজ, রবিবার পর্যন্ত। রয়েছে আরও ১২ জন শিল্পীর কাজ, যাঁরা রোজের সংসার-চাকরি সামলে নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন রং-তুলি-ক্যানভাসকেই। প্রথাগত শিক্ষা না পাওয়া এই শিল্পীদের কাজ জনসমক্ষে আসে না প্রায় কখনওই। তাঁদের উৎসাহ জোগাতেই এই আয়োজন করা হয়েছে বলে জানালেন শিল্পী তানিশা নীলম দাস। এই শিল্পীরা কেউ ডাক্তার, কেউ গৃহবধূ, কেউ আবার স্কুলপড়ুয়া।
গুয়াহাটি থেকে এসেছেন ডাক্তার ম্যাডোনা বরদলই কলিতা। তাঁর ক্যানভাসে উজ্জ্বল অ্যাক্রিলিক রঙে ধরা পড়েছে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জীবন-সংস্কৃতি। তিনি চান তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ জানুন ওই রাজ্যগুলিকে। সুরজ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র শৌর্য বাগচির পছন্দের বিষয় প্রকৃতি। রাজার আবার বেশি পছন্দ রথের মেলা বা দুর্গাপুজোর উন্মাদনা। গৃহবধূ মণিমালা দাসের পেন্টিংয়ে ফিরে ফিরে আসে প্রকৃতি ও নারীর স্বাভাবিক সহাবস্থানের বিষয়টি। সকলের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনাতেই যেন বাঁধা পড়েছে প্রদর্শনীর থিমটি— আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের সৃষ্টিকে আলোয় আনার তৃপ্তি।
এই উদ্যোগে সহায়তা করেছে পথশিশুদের কাছে উদ্বৃত্ত খাবার পৌঁছে দেয় এমন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ওই সংস্থার তরফে চন্দ্রশেখর কুণ্ডু জানাচ্ছেন, তাঁদের কয়েক জন সদস্য মাঝেমধ্যে গড়িয়াহাটের আশপাশে থাকা পথশিশুদের আঁকা, গান, নাচের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। কেউ আবার কিনে দেন আঁকার সরঞ্জামও। রোজকার গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াইয়ের বাইরে আলাদা একটা জগতের সন্ধান দেন ওদের। রাজা জানাচ্ছে, অনেক বছর আগে তাদের পড়াতে আসতেন এক দাদা। তিনিই ওদের আঁকতে শিখিয়েছিলেন। আর সেই সূত্রেই বন্ধুত্ব হয় সুরজের সঙ্গে। এখন ওদের দেখাদেখি আঁকা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে আরও কয়েক জন পথশিশু। প্রদর্শনীর উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে পথশিশু এবং অনাথ আশ্রমের আবাসিকদের আঁকা বেশির ভাগ ছবি। সেই অর্থ সরাসরি তুলে দেওয়া হবে তাদের হাতেই।
বয়স বাড়ছে, বাড়ছে আরও বেশি উপার্জনের তাগিদ। এত প্রতিকূলতার মধ্যে আঁকো কখন? অনাবিল হাসে রাজা-সুরজ দু’জনেই। ‘‘যা-ই হয়ে যাক, আঁকা কখনও ছাড়তে পারব না’’— বলে ওরা। ওদের আগ্রহ, ভালবাসা আর জেদকেই যেন স্বীকৃতি দিয়ে গেল এই প্রদর্শনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy