Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘ছেলেটা মরে গেছে, ব্রট ডেড কথাটা লেখারও লোক নেই হাসপাতালে’

বৃহস্পতিবার দুপুরে একটা ট্যাক্সি বেরোচ্ছিল মহানগরীর এক সরকারি হাসপাতাল থেকে। ট্যাক্সিতে শোয়ানো ট্যাংরা থেকে আসা কিশোরের নিথর দেহ। সমস্ত শরীর ঠান্ডা। হাসপাতালের দরজায় একটু থমকাল ট্যাক্সিটি। মৃত কিশোরের কাকা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘ছেলেটা মরে গেছে। ‘ব্রট ডেড’ কথাটা লেখারও লোক নেই হাসপাতালে।’’

কর্মবিরতিতে জুনিয়র ডাক্তাররা। নিজস্ব চিত্র।

কর্মবিরতিতে জুনিয়র ডাক্তাররা। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৬ ১৫:৫৬
Share: Save:

বৃহস্পতিবার দুপুরে একটা ট্যাক্সি বেরোচ্ছিল মহানগরীর এক সরকারি হাসপাতাল থেকে। ট্যাক্সিতে শোয়ানো ট্যাংরা থেকে আসা কিশোরের নিথর দেহ। সমস্ত শরীর ঠান্ডা। হাসপাতালের দরজায় একটু থমকাল ট্যাক্সিটি। মৃত কিশোরের কাকা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘ছেলেটা মরে গেছে। ‘ব্রট ডেড’ কথাটা লেখারও লোক নেই হাসপাতালে।’’

তার কিছুক্ষণ পরেই এক মহিলাকে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে দেখেছে হাসপাতালের গেটে দাঁড়ানো পুলিশ। মহিলার এক বছর বয়সী মেয়েটি পয়সা গিলে ফেলেছে। হেঁচকি উঠছে। মিনিট দশেক ধরে হাসপাতালের এদিকওদিক পাগলের মতো দৌড়ে মহিলা বুঝতে পারলেন ওই হাসপাতালে আর চিকিৎসা হবে না। ফের শুরু হল মেয়ে কোলে দৌড়। অন্য হাসপাতালের উদ্দেশে।

দুপুর ২টো নাগাদ মাইকে ঘোষণা হয়, শুধুমাত্র স্ত্রী রোগ বিভাগে যাঁরা ডাক্তার দেখাতে এসেছেন, তাঁরা ভিতরে আসতে পারেন। ওই বিভাগে ডাক্তার এসেছেন। পড়িমরি করে কিছু মানুষ দৌড়ন ওই বিভাগের দিকে। কেউ কেউ রোগিণীকে পাঁজাকোলা করে দৌড়তে থাকেন। হতাশ হয়ে বসে থাকেন অন্য বিভাগে আসা রোগীরা।

ঘটনাস্থল পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আশপাশের লোকেরা বুধবার রাত থেকেই ওই হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা বন্ধ করছিলেন। ওঁরা জেনে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি পালন করছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকা থেকে যে সব রোগী ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে ওই হাসপাতালে আসছিলেন, এলাকার লোকেরা তাঁদের জানিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘‘মাত যাও। স্ট্রাইক হ্যায়।’’ কিন্তু যাঁরা ট্যাক্সি বা অ্যাম্বুল্যান্সে চেপে একবার ঢুকে পড়েছেন হাসপাতালের সদর দরজা দিয়ে, তাঁদের ভোগান্তির অন্ত ছিল না।

হাসপাতালের আউটপোস্টে ডিউটিরত এক কনস্টেবল বলছিলেন, ‘কলকাতার সব শ্মশান মাসে একদিন একবেলার জন্য বন্ধ থাকে। কারণটা রক্ষনাবেক্ষণ। আর কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলির কোনও না কোনওটা মাসে ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। কারণটা জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। জুন মাসে এসএসকেএম হাসপাতালে আন্দোলন চলেছে দেড় দিন। জুলাইয়ে ন্যাশনাল।’ কিন্তু যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁরা দুষছেন পুলিশকে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ভিতরে একদল মারমুখী লোক ঢুকে পড়ছে রে রে করে। ভাঙচুর চালাচ্ছে, ডাক্তারদের পেটাচ্ছে। সব হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশ আসছে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছেন। কর্মবিরতি উঠে যাচ্ছে। মাস খানেকও যাচ্ছে না। ফের অন্য হাসপাতালে ঘটছে একই ঘটনা। এদিন সন্ধ্যায় যেমন শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়েই কর্মবিরতি তুললেন ন্যাশনালের জুনিয়র ডাক্তারেরা।

তবে ওই হাসপাতালে কিংবা শহরের অন্য কোনও হাসপাতালে যে এমন ঘটনা আর ঘটবে না তা জোর দিয়ে তা বলতে পারলেন না রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের কেউই। হতাশ স্বাস্থ্যকর্তারা বললেন, ‘‘নিরাপত্তা বাড়ানো হবে ঠিকই। কিন্তু পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ করে হাসপাতালকে তো আর যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে তোলা যাবে না!’’

বুধবার ঠিক কী হয়েছিল ন্যাশনালে? এক রোগীর মৃত্যুকে ঘিরে বুধবার রাতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। মৃতের পরিজনেরা গৌরীশঙ্কর মহাপাত্র নামে এক জুনিয়র ডাক্তারকে মারধর করেন। তাঁকে আইটিইউ-তে ভর্তি করতে হয়। এর জেরে রাত থেকেই হাসপাতালে কাজ বন্ধ করে দেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের অভিযোগ, ইমার্জেন্সি থেকে শুরু করে ওয়ার্ড-কোথাওই নিরাপত্তা নেই তাঁদের। রোগীর সঙ্গে যতজন পারছেন বাইরের লোক ভিতরে ঢুকে পড়ছেন। তার পর সামান্য এ দিক ও দিক হলেই চড়াও হচ্ছেন ডাক্তারদের ওপরে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

ন্যাশনাল মেডিক্যালের এক ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার বলেন, ‘এখানে অধিকাংশ রোগীকে যখন ইমার্জেন্সিতে আনা হয় তখন গোটা পাড়া সঙ্গে আসে। প্রথম থেকেই তাঁরা মারমুখী থাকেন। সিকিউরিটির লোকেরা অধিকাংশই অবসরপ্রাপ্ত লোক, প্রবীণ। নিজেরা মার খাওয়ার ভয়ে কাউকে আটকান না। পুলিশও উধাও হয়ে যায়। কিছু বললে বলে, ‘আমাদের লোক নেই।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘ভিজিটিং আওয়ার্সে একটা কার্ড নিয়েও ১০-১২ জন ওয়ার্ডে চলে যাচ্ছে। গেটে নিরাপত্তাকর্মী কাউকে আটকাচ্ছেন না। ভিজিটিং আওয়ার্সের পরেও তাঁরা বহাল তবিয়তে ওয়ার্ডে রয়ে যাচ্ছেন।’’ এই অভিযোগ অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলির ডাক্তারদেরও।

আরও পড়ুন:ডাকাতিতে ফের বহিরাগত-প্রশ্ন

কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলির যা পরিস্থিতি তাতে বহিরাগত ঠেকানো কি সত্যিই সম্ভব? নীলরতন সরকার হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘প্রত্যেক হাসপাতালে কর্মীর অভাব। ট্রলি জোগাড় করে তাতে রোগীকে তুলে ঠেলে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে স্যালাইনের নল ঠিক করা—সবকিছুই রোগীর বাড়ির লোককে করতে হয়। বাইরের লোক না ঢুকলে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাবে।’’

ন্যাশনালের জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে সৌরভ সাহা বলেন, ‘‘আমরা চাই হাসপাতালে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হোক। রোগীর সঙ্গে শুধুমাত্র একজনকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হোক। ভেতরে ঢোকানোর আগে বাড়ির লোকের পোশাক তল্লাসি হোক। কারণ এর আগে ছুরি নিয়ে ভিতরে ঢোকার ঘটনাও ঘটেছে।’’

রাতে ন্যাশনালের সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। কে, কোথায় থাকবেন সেটা আমরাই ঠিক করে দেব। কারণ স্পর্শকাতর জায়গাগুলি আমরা জানি।’’

কী করছে স্বাস্থ্য ভবন? পর পর কর্মবিরতির ধাক্কায় হতাশ শোনায় স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা। তিনি বলেন, ‘‘আর কত পুলিশ থাকবে? হাসপাতাল কি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে? আমরা আর কী করতে পারি, সেটাই বুঝতে পারছি না। যাতে ঠিকঠাক ধরপাকড় হয়, জামিনঅযোগ্য ধারা প্রয়োগ হয়, পুলিশকে সে ব্যাপারে অনুরোধ করেছি। দু’জন ধরাও পড়েছে। কিন্তু এর পর কী, সে ব্যাপারে আমরা নিজেরাও নিশ্চিত নই।’’

বুধবারের ঘটনায় পুলিশ মহম্মদ সরফরোজ এবং শাবানা খাতিন নামে মৃতের দুই আত্মীয়কে গ্রেফতার করেছে। এ দিন শিয়ালদহ আদালতে পেশ করা বলে ২৮ জুলাই পর্যন্ত তাঁদের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয় আদালত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE