Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ফের সেই যাদবপুরে ছাত্রীকে নিগ্রহের অভিযোগ

আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আবার শ্লীলতাহানির অভিযোগ ঘিরে উত্তেজনা। গত বছর অগস্টে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের জেরে তৈরি হওয়া ঘটনাপ্রবাহে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে। সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই ফের তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুললেন এক ছাত্রী। এ বারেও অভিযোগের আঙুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রদের বিরুদ্ধে। এবং এ বারেও অভিযোগকারী ছাত্রী কলা বিভাগের পড়ুয়া। অগস্ট মাসের ঘটনায় পুলিশ তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করেছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৩
Share: Save:

আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আবার শ্লীলতাহানির অভিযোগ ঘিরে উত্তেজনা।

গত বছর অগস্টে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের জেরে তৈরি হওয়া ঘটনাপ্রবাহে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে। সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই ফের তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুললেন এক ছাত্রী। এ বারেও অভিযোগের আঙুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রদের বিরুদ্ধে। এবং এ বারেও অভিযোগকারী ছাত্রী কলা বিভাগের পড়ুয়া। অগস্ট মাসের ঘটনায় পুলিশ তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করেছিল। পরে তাঁরা শর্তসাপেক্ষে জামিন পান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনার যে তদন্ত করেছিলেন, তার পরিণতি এখনও জানা যায়নি। এ বারের ঘটনায় কলা শাখার ওই ছাত্রীর করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা রুজু করেছে যাদবপুর থানা। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তে যায় পুলিশ। এই ঘটনা নিয়ে পাল্টা অভিযোগ জমা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একদল ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাল্টা চিঠি লিখে জানিয়েছেন, শ্লীলতাহানির অভিযোগ ঠিক নয়। একটা বচসার ঘটনা ঘটেছে মাত্র। এই ঘটনায় শনিবার রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠায় উদ্বিগ্ন কর্তৃপক্ষ। ঘটনার কথা শুনে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা এখনই এর মধ্যে ঢুকছি না। কিন্তু আবার সেই যাদবপুর! জানি না কেন এ সব ঘটছে। আমি বারবার সকলকে সংযত হতে বলছি।”

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসব (ফেস্ট) শুরু হয়েছে গত ১৪ মার্চ থেকে। আজ, রবিবার পর্যন্ত তা চলার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ফেস্ট চলাকালীন অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়াতে নজরদারি চালানোর জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্র সংসদ ‘ফেটসু’-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই কারণে গেটে দাঁড়িয়ে আগত ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করা হচ্ছিল বলে ফেটসু-র দাবি। একটি সূত্রের বক্তব্য, কারও ব্যাগে মাদকদ্রব্য রয়েছে কি না, সেটাই মূলত দেখা হচ্ছিল। অভিযোগ, শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কলা শাখার ওই ছাত্রী অনুষ্ঠানে ঢুকতে গেলে সমস্যার শুরু হয়। ওই ছাত্রীর অভিযোগ, তখনই তাঁর সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র।

কী বলছেন ওই ছাত্রী? স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ওই পড়ুয়া এ দিন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন এয়ার থিয়েটারে (ওএটি) ফেটসু-র ফেস্ট চলছে। শুক্রবার সেখানে ঢুকতে গেলে গেটে দাঁড়ানো ছাত্রছাত্রীরা আমার পথ আটকায়। ছাত্রীরা ব্যাগ দেখতে চাইলে আমি অস্বীকার করি। তখন আমাকে বলা হয়, ব্যাগ না দেখালে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আমাকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়।” ওই ছাত্রীর অভিযোগ, এর পরেই সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েক জন ছাত্র তাঁকে ঘিরে ধরেন। অভিযোগকারীর কথায়, “১০-১৫ জন ছাত্র আমাকে ঘিরে ধরে গালিগালাজ করে, আজেবাজে কথাও বলে। তিনটি ছেলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।” ঘটনার সময় তাঁর শ্লীলতাহানি করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন ছাত্রীটি। অভিযুক্ত তিন জনের মধ্যে দুই ছাত্রের নাম জানিয়েছেন তিনি। তৃতীয় অভিযুক্তের মুখ চেনা হলেও তাঁর নাম জানাতে পারেননি।

ঘটনার পরে রাতেই তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে যাদবপুর থানায় এফআইআর করেন ওই পড়ুয়া। শনিবার সকালে যাদবপুরের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রীটির পরীক্ষা হয়। মেডিক্যাল রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তাঁর ডান হাতে কাটার দাগ আছে। এ দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, রেজিস্ট্রার এবং অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস কমিটি)-র কাছে লিখিত অভিযোগ জানান ছাত্রীটি।

ছাত্র সংসদের তরফে শুভব্রত দত্ত বলেন, “ছেলে ও মেয়েদের দু’টি পৃথক লাইনে ব্যাগ চেক করা হচ্ছিল। তখনই একটি ঘটনা ঘটে। অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর। আমরা চাই, এর যথাযথ তদন্ত হোক। তার পরেই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা যাবে।”

কিন্তু অনুষ্ঠানে ঢোকার সময় ব্যাগ তল্লাসিতে আপত্তি করলেন কেন? ওই পড়ুয়ার জবাব, “ছাত্রছাত্রীরা যে কোনও ধরনের নজরদারির বিরুদ্ধে। ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারগুলিতে পুলিশ পিকেটিংয়ের বিরোধিতা করেছিলাম। ব্যাগ দেখে অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়া এক ধরনের নজরদারিই। তাই আমি এতে আপত্তি জানাই।” তাঁর যুক্তি, মাদকদ্রব্য আটকাতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র তা রোধ করতে হবে। কেবল অনুষ্ঠানের ভিতরে মাদক নিষিদ্ধ এই যুক্তি ভিত্তিহীন। ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, শুক্রবার রাতে শ্লীলতাহানির কোনও ঘটনা ঘটেনি। এক দল ছাত্রীর সঙ্গেই অভিযোগকারীর ধস্তাধস্তি হয়।

গত অগস্টের ঘটনাটিও ঘটেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন। সেই অভিযোগের তদন্তভার একটি কমিটির হাতে তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় একাংশ। ১৬ সেপ্টেম্বর উপাচার্য-সহ এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল (ইসি)-এর সদস্যদের ঘেরাও করেন বিক্ষোভকারীরা। ঘেরাও তুলতে রাতে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকেন অভিজিৎবাবু। সেই রাতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশি তাণ্ডবের পরে সংগঠিত ‘হোক কলরব’ আন্দোলন-এর জেরে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কার্যত পদত্যাগে বাধ্য হন অভিজিৎবাবু। সেই শ্লীলতাহানির অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জমা পড়লেও তা প্রকাশ করেননি কর্তৃপক্ষ। রিপোর্টটি নিয়ে কী ভাবে এগোনো উচিত, সে ব্যাপারে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) জয়ন্ত মিত্রের মতামত চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ‘ঢিলেঢালা মনোভাবে’ হতাশ সে দিনের অভিযোগকারী পড়ুয়া। শুক্রবারের ঘটনায় মতামত জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “যে ছাত্ররা এই ধরনের কাজ করছেন, তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন যে, কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেবেন না। আমার ঘটনায় যদি কর্তৃপক্ষ কোনও কড়া পদক্ষেপ করতেন, তা হলে ফের এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস কারও হত না। এমন গুরুতর অভিযোগ পেয়ে কর্তৃপক্ষ কী করে গা-ছাড়া মনোভাব দেখান, তা জানি না!”

এ বারের অভিযোগকারী ছাত্রী অবশ্য বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, “এখনও গত অভিযোগের কোনও সুরাহা হয়নি, অভিযোগকারীও বিচার পাননি। তবে আমি আশা করছি একটা কিছু হবে।” তাঁর আক্ষেপ, “বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বড় আন্দোলন হয়ে গেল, তার পরেও ক্যাম্পাসে সচেতনতা তৈরি হল না! এটা এক দিকে যেমন কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, তেমনই ছাত্রছাত্রীদেরও ব্যর্থতা।”

কিন্তু ক্যাম্পাসের মধ্যে বারবার কেন শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠছে, তা ভাবাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য তথা সহ-উপাচার্য আশিসস্বরূপ বর্মার কথায়, “এর উত্তর আমার কাছে নেই। সকলের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি।” তবে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগ দেখে অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়ার ব্যবস্থাকে সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। আশিসবাবুর কথায়, “ওই কাজ করতে গিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE