Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দিন গুজরান ফুটপাতে, আঁকার খাতায় রঙিন বাড়ি

ছোট্ট একটি বাড়ি। বাংলো নয়, টালির চাল। তাতেই যথেচ্ছ রং। সামনে অনেকটা ঘাস। ছোট্ট পড়ার জায়গা। চার দিকে গাছগাছালি। কমলা, বেগুনি, নীল, গোলাপি, হলুদ— কী নেই সেই ছবিতে! 

স্বপ্ন: আঁকার খাতা সঙ্গে নিয়ে বসেছে আসর। সম্প্রতি, শহরের একটি স্কুলে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

স্বপ্ন: আঁকার খাতা সঙ্গে নিয়ে বসেছে আসর। সম্প্রতি, শহরের একটি স্কুলে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ছোট্ট একটি বাড়ি। বাংলো নয়, টালির চাল। তাতেই যথেচ্ছ রং। সামনে অনেকটা ঘাস। ছোট্ট পড়ার জায়গা। চার দিকে গাছগাছালি। কমলা, বেগুনি, নীল, গোলাপি, হলুদ— কী নেই সেই ছবিতে!

রঙের বৈচিত্র্য কম নেই অলিম্পিক জয়ের আনন্দেও। ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মেডেল নিচ্ছে শিশু। নানা রঙের ছটায় সংবর্ধনা দিচ্ছে তাকে গোটা দুনিয়া।

বিবরণই বলে দেয়, এগুলি আশপাশের কোনও অঞ্চলের বাস্তব-চিত্র নয়। তবে অবাস্তবও নয়। এ দু’টিই এ শহরের স্বপ্ন।

নিমন্ত্রণ ছিল রংপেন্সিল হাতে স্বপ্ন দেখার। সেই সুবাদেই একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল ওরা। ওরা মানে, এ শহরেরই ফুটপাতের ধারে কিংবা কোনও এক কোণের বস্তির সংসারে বড় হওয়া স্কুলপড়ুয়ারা। সকলেরই বয়স ৮-১৪ বছরের মধ্যে। অধিকাংশেরই পারিবারিক আয় দারিদ্রসীমা ছুঁই ছুঁই। এরই সঙ্গে কারও কারও রয়েছে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা। তাদেরই স্বপ্নের খোঁজ নিতে শহরের একটি নামী স্কুলে হয়েছিল আয়োজন। সেখানেই রং-তুলি, প্যাস্টেল হাতে ‘আমার স্বপ্ন’ আঁকতে বসেছিল একসঙ্গে ৩০০০ জন।

বাস্তবটা স্বপ্নের এই ছবির থেকে বহু দূরে। বাগান দেওয়া বাড়ির অস্তিত্ব তো নেই তাদের কারও জীবনে, বরং মাথার উপরে ছাদই নেই এই ছবির খুদে শিল্পীর। আয়োজকদের তরফে প্রহ্লাদ কেডিয়া জানালেন, ফুটপাতের সংসার থেকেই রোজ স্কুলে যাতায়াত ওদের অনেকের। তাই বুঝি এত জন বাড়ির ছবি এঁকেছে। অলিম্পিক জয়ের ছবি যে এঁকেছে, তার নেই খেলতে যাওয়ার মতো শারীরিক ক্ষমতা। মনোবিকাশ কেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াতেই দিন কাটছে তার। অর্থাৎ, ছোট্ট মানুষটা দিনে জেগে যে খেলার মাঠে পৌঁছতে পারে না, রাতের ঘুমের মাঝে সেই আনন্দের জায়গায় পৌঁছয় সে।

শহরের দুঃস্থ শিশুদের নিয়ে কাজ করা কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে গত ছ’বছর ধরে হচ্ছে এই আঁকার প্রতিযোগিতা। কড়া বাস্তবের নানা ঝড়ঝাপ্টা সামলে যাদের বড় হওয়ায় থাকে না বিশেষ রং, একটা দিন তাদেরই বসিয়ে দেওয়া হয় রং হাতে। তবে আয়োজকেরা জানালেন, স্বপ্নকেও যে বাস্তবই নিয়ন্ত্রণ করে, তা বারবার ফিরে আসে এই শিশুদের ছবিতে। প্রহ্লাদ বললেন, ‘‘ওদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে দেখেছি, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই খুব কঠিন। এ বার এক জনের ছবিতে খুঁজে পেলাম তার কারণ। ‘স্টপ চাইল্ড লেবার’ পোস্টার দেখলাম তার ছবিতে। আমরা যে শিশুদের পড়াশোনা নিয়ে কাজ করি, তাদের মতো পরিবারের অনেককেই ছোটবেলায় কাজে যোগ দিতে হয় বাড়ির প্রয়োজনে।’’ প্রসঙ্গত, শুধু শিশুশ্রম বিরোধী ছবিই নয়, মিলেছে নাবালিকা বিবাহ বন্ধের আর্জি জানানো ছবিও।

প্রান্তিক শিশুদের নিয়ে কাজ করা তরুণ শিল্পী কৌস্তুভ চক্রবর্তী জানালেন, এ শহরের ফুটপাতবাসী বহু শিশুর মধ্যেই সুন্দর বাড়ি, সুখের সংসারের ছবি আঁকার প্রবণতা খেয়াল করেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘যে শিশুদের নিয়ম করে আঁকা শেখার অভ্যাস নেই, তাদের ছবিতে মনটা বেরিয়ে আসে। ওরা যেখানে যেমন ইচ্ছে রং ব্যবহার করে সুখের ছবি আঁকে। ওদের ছবি দেখলে এক-এক সময়ে নাড়া দেয়, বোঝা যায় ওদের বাস্তবটা ছবির থেকে কত আলাদা।’’

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করান, বাড়ি মানেই একটি নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ। তাই কোনও শিশুর আঁকার খাতায় বাড়ির ছবি উঠে আসার আলাদা তাৎপর্য থাকে। তার হাতে আঁকা ছবিই বলে দেয়, সেই শিশু নিরাপত্তা খুঁজছে। তিনি বলেন, ‘‘সব ক’টি ছবিতেই যেন একটা কান্না ফুটে উঠছে। প্রত্যেকেই এক-একটা জায়গায় বঞ্চিত, সেই অসুবিধে কাটিয়ে ওঠার আকুতি যেন ছবিগুলির মধ্যে। নিজের শিল্পের মাধ্যমে ‘আমার আমি’টাই ফুটিয়ে তুলতে চাইছে শিশু-মন।’’

তবে বাস্তবটা যেমনই হোক, এ শহর যে এখনও স্বপ্ন দেখার উস্কানিটুকু দিতে সক্ষম, রঙে রঙে সে আশ্বাসকে কুর্নিশ তো জানায় ছবিগুলিই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drawing Competition Slum NGO
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE