Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘তোমারে যেন না করি সংশয়’

ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তাঁর জুনিয়র শিল্পীদেরও। জুনিয়রদের কেন?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ঈশানী দত্ত রায়
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৫২
Share: Save:

শিক্ষক দিবসে এই কাহিনিটা খুব মনে হয়।

হলিউডে অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপের প্রথম ফিল্মে ছিলেন ডাকসাইটে অভিনেত্রী জেন ফন্ডা। মেরিলের কথায়, প্রথম আলাপের পরে বড় দিদির মতোই গলা জড়িয়ে ধরে যিনি তাঁকে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন ফিল্মের নিজস্ব জগতে। গল্পটা এ রকম, প্রথম টেকের পরে মেরিল দুরন্ত আত্মবিশ্বাসী। জেন তাঁকে ডাকলেন। ‘‘নীচে ফ্লোরে তাকাও।’’ মেরিল দেখলেন, ফ্লোরে সবুজ একটা টেপ। জেন বললেন, ‘‘ওটাই তুমি। দ্যাটস ইউ, দ্যাটস ইওর মার্ক। একমাত্র ওই মার্কে দাঁড়ালে সেটের আলো তোমার উপরে পড়বে। ইউ আর ইন দ্য লাইটস। ইউ আর ইন দ্য মুভি।’’ ক্যামেরায় আসার এই মূল শিক্ষাই শুধু নয়, মেরিল জানিয়েছেন, শুটিং শেষ হওয়ার পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে জেন বহু লোককে বলেছিলেন তাঁর কথা। ফলে এসেছিল আরও সুযোগ। আনকোরার জন্য প্রতিষ্ঠিতের এই স্নেহ, মর্যাদা, সাহায্যের জন্য মেরিল ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন জেনকে। ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তাঁর জুনিয়র শিল্পীদেরও। জুনিয়রদের কেন? কারণ, নবাগতকে সাহায্য করা এবং সস্নেহ পরিচর্যার যে শিক্ষা জেনের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন, সেই ভালবাসা জুনিয়রদের দিতে পেরেছিলেন তিনি। এবং মেরিলের কথায়, ‘ইট ডাজ‌ কিপ গোয়িং।’’

শিক্ষক দিবসে ওই বালকের কথাও মনে হচ্ছে।

শনিবারের মেট্রোয় দেখেছিলাম এক গোলগাল বালক এবং তার পিসিকে (আন্দাজ আর কী)। মেট্রোয় উঠেই বালককে তিনি দেখাতে লাগলেন কামরার প্যানেলে স্টেশনের নামাবলি।

‘পড়ে নাও, কোনটার পরে কোনটা।’

বালক পড়ে, ‘... গিরিশ পার্ক, গাঁধী রোড...’’

‘‘গাঁধী রোড নয়, মহাত্মা গাঁধী রোড।’’

এর পরে বালক তার কোনও একটা ভয়ের কথা বলে।

পিসি জিজ্ঞেস করেন, ‘‘রাতে না হয় ভয় করে, দিনের বেলায় পারবি না?’’

‘‘না, আমার বড় ভয় করে।’’ বালক জড়িয়ে ধরে পিসিকে।

‘‘ভয়? ভয় পাওয়া মানে তো মরে যাওয়া। সব কিছুতেই এত ভয় কীসের তোর? আমার তো লজ্জা করছে, এত বড় একটা পুরুষমানুষ তুই, এত ভয়!’’

বালক শিখল, সহযাত্রীরাও শিখলেন। সস্নেহে পরতে পরতে শিক্ষা!

দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল এক শিশুর কথা। ইনফ্যান্ট-এ পরীক্ষার আগে ছোট হাতের আর বড় হাতের ইংরেজি হরফ শেখাতে গিয়ে মা কেঁদেই ফেলেছিলেন। কারণ, মেয়ে সবই উল্টোপাল্টা করে। তার উপরে রং-কানা। ফলে অ্যাডমিশন টেস্টের দিন সাদা ফ্রক পরিয়ে পাঠিয়েছিলেন, যাতে জামার রং জিজ্ঞেস করলে উল্টোপাল্টা বলে না আসে।

সে ছিল বটে এক দিন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে মাস্টারমশাই-দিদিমণিরাই ছিলেন আরাধ্য দেবতা। তাঁহারা যাহা বলিবেন, তাহাই বেদবাক্য। আরও অনেকেই বলেছিল। স্কুল, তার বিশাল বাগান, বন্ধুরা, বড় ছুটির আগে স্টেজে দাঁড়িয়ে দিদিমণিদের গান— যাবৎ নাহি হয় পুনঃ সাক্ষাৎ, শুভ সাক্ষাৎ যিশুর চরণে… ঈশ্বর থাকুন তোমারই সহায়’, তোমারই-র ই-তে দীর্ঘায়িত টান বলেছিল, আমি নয়, আমরা। সবই রহিয়া গিয়াছে।

দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ গার্লস হাইস্কুলে অঙ্কের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষিকা প্রণতি সেন যে ভাবে বই-খাতার মলাট দিতে শিখিয়েছিলেন, সন্তানের বই-খাতার মলাট দিতে গিয়ে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে তাঁর অনেক, অনেক ছাত্রী। হয়তো সেই সব ছাত্রীদের উত্তরাধিকারীরাও পালন করেছে এবং করবে মলাট কী ভাবে দিতে হয়, কী ভাবে খাতার পাতার দু’পাশে জায়গা রেখে অঙ্ক কষতে হয়। ল্যাপটপ, স্টাইলাসের সময়েও কখনও কখনও ভাবতেই হয়, হাতে ধরে উপলব্ধি করার মতো কিছু সাদা পাতা থাকা ভাল। এই একক চলার সময়ে সঙ্গে থাকা ভাল এই বোধটা— আমি নয়, আমরা!

মনে থাকে, ঊষাদি চিনিয়েছিলেন কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল। রুপোলি রাংতা কেটে তারার দল তৈরি করে অ্যালবামের কালো পাতায় আকাশ তৈরি করে ফেলতে শিখিয়েছিলেন। সেই কালো পাতার বিশালত্বে থোকা থোকা তারা সৃষ্টির রোমাঞ্চ কখন পুরো আকাশকে ঢুকিয়ে দিয়েছে বুকের মধ্যে।

সেই আকাশ সেই বালিকাকে, বালিকাদের কখনও ছাড়ে না। বালক-বালিকারা বড় হয়ে গিয়ে এক দিন বোঝে, ভরা পূর্ণিমার রাতে হঠাৎ আকাশে চোখ পড়লে শেখা যায়— ‘দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা, তোমারে যেন না করি সংশয়’— লাইনগুলোর অর্থ কী। আবার জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া আকাশের দিকে হাজার তাকিয়ে, শত চেষ্টা করেও কিছুতেই শেখা যায় না— ‘কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে।’ মনে হয়, এ কথা সত্যি নয়, হতেই পারে না।

সেই মিথ্যে-সত্য এবং তার মাঝখানে বিরাট একটা ধূসর জায়গা চিনতে চিনতে আরও কত বছর পেরিয়ে যায়। সেই ঊষাদি ছাত্রীর রোগশয্যায় দিয়ে যান যিশুর বাণী লেখা ছোট্ট কার্ড। প্রবাস যাত্রার আগে দেন কলম এবং যিশু কোলে মেরির মূর্তি-সহ সরু চেন— প্রবাসে রক্ষা করবে।

ছাত্রী সেগুলো হারিয়ে ফেলে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই। ভাজা মাছ উল্টে খেতে ততদিনে সে শিখে গিয়েছে। শেখাতে হয়নি।

আর তার জীবনে অভাব ঘটেছে প্রণাম করার মতো পায়ের পাতার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teachers day Teacher শিক্ষক
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE