এ যেন খিদেয় শরীর ভাঙে, তবু গুমোর যায় না।
আধুনিক অ্যাপ-ক্যাবের কাছে কোণঠাসা হয়ে প্রতিদিনই জমি হারাচ্ছে কলকাতার সাবেক হলুদ ট্যাক্সি। রাস্তায় বেরোলে যথেষ্ট সংখ্যক যাত্রী মেলে না, তবু যাত্রী প্রত্যাখানের অভ্যাসে বিরাম নেই।
পুলিশ, পরিবহণ দফতর, ট্যাক্সি ইউনিয়ন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও তাতে পরিস্থিতির বদলায় না। জরিমানা করা হলেও প্রবণতা একই থাকে।
২০১৪ সালের পর থেকে গত ৪ বছরে কলকাতা এবং শহরতলি এলাকায় হলুদ অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সির সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছে বলে পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনা মিলে হলুদ ট্যাক্সির বৈধ রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা এখন ১৭ হাজারের আশপাশে। কয়েক বছর আগেও তা ৪০ হাজারের কাছাকাছি ছিল। কলকাতা পিভিডি এলাকায় ওই সংখ্যা ১২ হাজারের কাছাকাছি। এই সংখ্যাও প্রতিদিন কমছে।
ইউনিয়নগুলির মতে ট্যাক্সি আর লাভজনক না হওয়ায় অনেকেই পেশা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছেন। অ্যাম্বাসাডরের বাণিজ্যিক উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পরে ট্যাক্সির যন্ত্রাংশ এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। যাঁরা পুরনো ট্যাক্সি বিক্রি করে দিচ্ছেন তাঁরা আর নতুন করে পারমিট নিতে চাইছেন না। সরকারি বিধি মেনে যে সব ট্যাক্সির বয়স ১৫ বছর পেরিয়েছে সেগুলি স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার জায়গায় নতুন পারমিটের আবেদন করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না চালকেরা। বয়স্ক চালকদের বেশির ভাগই ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর দিকে ঝুঁকছেন। অনেকে কাজ খুঁজে নিচ্ছেন ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। অল্পবয়সীরা চলে যাচ্ছেন অ্যাপ-ক্যাবের দিকে।
আরও পড়ুন: কমছে ব্যবসা, তবু চলছে প্রত্যাখ্যান
এক ট্যাক্সিচালক সৎনাম সিংহের কথায়, “আজকালকার ছেলেমেয়েরা ট্যাক্সি চ়ড়তে চায় না। ২২ বছর ট্যাক্সি চালাচ্ছি। চেনা কিছু যাত্রী আছেন, তাঁরাই মাঝেমধ্যে ফোন করে ডেকে পাঠান বলে কোনও মতে চলে যায়।”
কিন্তু সরকারের তরফে হলুদ ট্যাক্সির ভাড়া বাড়ানো হলেও ব্যবসা অলাভজনক বলছেন কেন চালকেরা? কেনই বা চলছে যাত্রী প্রত্যাখ্যান?
কলকাতার সিটু পরিচালিত ট্যাক্সি ইউনিয়নের নেতা প্রসাদ গুহের মতে, ট্যাক্সিচালকেরা মূলত অংসগঠিত। বেশির ভাগ চালক ভাড়ায় অন্যের ট্যাক্সি চালান। ফলে প্রতিদিন গাড়ির ভাড়া বাবদ সাড়ে তিনশো থেকে সাড়ে চারশো টাকা তাঁদের মালিককে দিতে হয়। এর বাইরে তেলের খরচ রয়েছে। একবার যাত্রী নামিয়ে ফের কাছাকাছি যাত্রী পাওয়া নিয়েও সমস্যায় পড়তে হয়। অ্যাপ-ক্যাবে সেই সমস্যা নেই। ক্যাব সংস্থা দু-এক কিলোমিটারের মধ্যে নতুন যাত্রীর সন্ধান জানিয়ে দেয়।
অ্যাম্বাসাডরে জ্বালানির খরচ অ্যাপ-ক্যাবের থেকে খানিকটা বেশি। তুলনায় স্বাচ্ছন্দ্য কম। ফলে চালকেরা খালি ট্যাক্সি নিয়ে যাত্রী খোঁজার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে চান না। একবার যাত্রী নামিয়ে ফের যাত্রী তোলার জন্য ৪-৫ কিলোমিটার ছুটতে হলে অনেক টাকা বেরিয়ে যায়। ক্ষতি এড়াতে শহরের মূল বাণিজ্যিক এলাকা বা হাতে গোনা ব্যস্ত গন্তব্যের মধ্যেই ঘোরেন বেশির ভাগ চালক।
অভিযোগ, রাতে খালি গাড়ি নিয়ে ফেরার খরচ পুষিয়ে নিতে চালকদের একাংশ চড়া ভাড়া হাঁকেন। ট্যাক্সি ইউনিয়নের নেতাদের মতে, আশু লাভের কথা ভাবতে গিয়ে সার্বিক ভাবে ট্যাক্সি ব্যবসার মূলেই ঘা মারছেন চালকরা। পরিষেবা না পেয়ে যাত্রীরা অন্য মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছেন।
এআইটিইউসি অনুমোদিত ট্যাক্সি ইউনিয়নের নেতা নওলকিশোর শ্রীবাস্তব বলেন, “অ্যাপ-ক্যাব সংগঠিত ব্যবসা বলে ওরা ঘুরপথে ইচ্ছে মতো ভাড়া আদায় করে। তুলনায় ট্যাক্সির ভাড়ার হিসেব অনেক সরল। তবুও নানা কারণে যাত্রী হারাচ্ছে ট্যাক্সি। যাত্রী প্রত্যাখান না করার জন্য চালকদের বোঝাচ্ছি।”
বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি বলবিন্দর সিংহের মতে, ট্যাক্সিচালকদের টিকে থাকতে হলে এই ব্যবসাকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। যাত্রীরা স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিষেবার জন্য মূল্য দিতে চান। কিন্তু ক্ষতি এড়াতে গিয়ে ট্যাক্সিচালকদের একাংশের মিটারের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতা যাত্রীদের তাঁদের প্রতি অনাস্থাশীল করে তুলছে। কিছু জায়গায় প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy