Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হাসপাতালেই পড়ছেন সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত

সন্তানের এমন শারীরিক সমস্যা নিয়ে সে সময়ে নাজেহাল দশা কুরিয়ার কর্মী গোপেশ মুখোপাধ্যায় ও গৃহবধূ অরুণার।

লড়াকু: এসএসকেএমে তনুশ্রী। নিজস্ব চিত্র

লড়াকু: এসএসকেএমে তনুশ্রী। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৩১
Share: Save:

‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’— পছন্দের গানটি স্বরলিপি দেখে শেখার ইচ্ছে ছিল অনেক দিনই। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি আজও। কারণ, আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসায় মাঝপথে গান শেখা বন্ধ করতে হয়েছে বছর আঠেরোর তরুণীকে। কিন্তু তাই বলে লেখাপড়াও বন্ধ হতে দিতে নারাজ সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত, উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরের তনুশ্রী মুখোপাধ্যায়। তাই গত একমাস ধরে এসএসকেএম হাসপাতালের শয্যাতেই নিয়মিত পড়তে বসছেন তিনি। মায়ের মুখে শুনে শুনেই মুখস্থ করে ফেলছেন উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস।

তিন বছর বয়স পর্যন্ত তেমন কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না তনুশ্রীর। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কমতে থাকে দৃষ্টিশক্তি। কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এক সময়ে পরিস্থিতি এমন হয় যে, কেউ না ধরলে দু’পায়ে দাঁড়াতে পারতেন না। হাতের সমস্যা না থাকলেও ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির ফলে লিখতে সমস্যা হত।

সন্তানের এমন শারীরিক সমস্যা নিয়ে সে সময়ে নাজেহাল দশা কুরিয়ার কর্মী গোপেশ মুখোপাধ্যায় ও গৃহবধূ অরুণার। মেয়ের চিকিৎসার জন্য ভিন্ রাজ্যে যেতেও পিছপা হননি তাঁরা। তবে লাভ হয়নি। তাঁদের দাবি, মেয়ের কী হয়েছে তা বলতে পারেননি কোনও চিকিৎসকই। অরুণাদেবী বলছেন, ‘‘আচমকা দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে, হাঁটতে পারছে না কেন, বুঝতে পারছিলাম না। কেউই ঠিক করে বলতে পারছিলেন না, মেয়ের কী রোগ হয়েছে।’’ ১০ বছরে কয়েক লক্ষ টাকা খরচের পরেও দিশা না মেলায় ২০১৮ সালে প্রায় সব আশাই ছেড়ে দেন তাঁরা। কিন্তু এক আত্মীয়ের পরামর্শে ফের চিকিৎসা শুরু করেন।

গত ৬ অগস্ট এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তনুশ্রীকে। তখনই জানা যায়, সেরিব্রাল পলসি রোগে আক্রান্ত ওই তরুণী। সেদিন থেকে এসএসকেএম-ই ঠিকানা মা-মেয়ের। এসএসকেএমের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে তনুশ্রীর চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলছেন, ‘‘ছোট থেকেই উনি ছিলেন মাইল্ড স্প্যাস্টিক। কিন্তু ঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় সমস্যা ক্রমশ বেড়েছে। এখন ওঁর বিভিন্ন শারীরচর্চা, অকুপেশনাল থেরাপি-সহ অন্য চিকিৎসা, ওষুধ চলছে। তাতে আগের তুলনায় পায়ের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা ফিরেছে।’’ ওই চিকিৎসক আরও জানাচ্ছেন, মূলত সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ওই তরুণীর হাঁটাচলার ক্ষমতা প্রায় ছিল না বললেই চলে। এখনও মাত্র তিন ফুট দূরত্বে আঙুলের নাড়াচাড়াটুকু শুধু দেখতে পান। তবে বর্তমানে নিজে থেকে দাঁড়াতে পারছেন ওই তরুণী। ওঁর বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ।

তবে অসুখের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হতে দিতে চান না ওই অষ্টাদশী। তাই হাসপাতালে বসেই মায়ের সাহায্যে চলছে পড়াশোনা। অরুণাদেবী বলছেন, ‘‘ওর বাবা রোজ স্কুলে দিয়ে আসতেন। আমি কোলে করে নিয়ে আসতাম। বন্ধুরা ও শিক্ষিকারা ধরে ধরে হাঁটাচলা করাতেন। মাধ্যমিকের আগে শুনে শুনেই মুখস্থ করে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে।’’ সামনের বছরে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডিও তাই ‘রাইটার’-এর হাত ধরেই পেরোতে চান তনুশ্রী। সাহায্য মিলছে চিকিৎসকদের থেকেও। তনুশ্রীর শুনে শুনে মুখস্থ করার ক্ষমতা দেখে মোবাইলে বিভিন্ন ভয়েস অ্যাপের ব্যবহার শেখাতে শুরু করেছেন চিকিৎসকেরা। রাজেশবাবু জানিয়েছেন, এ বার আতস কাচ দিয়ে লেখার প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে তনুশ্রীকে। তাঁদের আশা, ভবিষ্যতে নিজে নিজে হাঁটাচলা করার ক্ষমতা ফিরলে চাকরিও করতে পারবেন ওই তরুণী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cerebral Palsy SSKM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE