অসচেতন: এ ভাবেই যত্রতত্র চলছে পিক ফেলা। মঙ্গলবার, বড়বাজার এলাকায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে চলতি আর্থিক বছরে কলকাতা পুরসভা বরাদ্দ করেছে প্রায় ৫৯৬ কোটি টাকা! অন্য সমস্ত খাতের বরাদ্দকে যা ছাপিয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গত বছরের থেকেও যা প্রায় ৭১ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু বাজেট তৈরির সময়ে পুরকর্তারা হয়তো জানতেন না, প্রায় ১৪০ কোটি টাকা খরচ হয় শহরকে অপরিষ্কার করতে! বুঝতে পারলে জঞ্জাল খাতে আরও বরাদ্দ করা যায় কি না, সে সম্পর্কে হয়তো আলোচনা করতেন তাঁরা।
‘গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে’ (গ্যাটস-২, ২০১৬-’১৭) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর শহর শুধু ১৩৯ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকার গুটখা ও তামাকমিশ্রিত পানমশলার পিকে ভর্তি হয়ে যায়! (প্রকৃত সংখ্যাটি হল, ১৩৯ কোটি ৮৫ লক্ষ ২৬ হাজার ৭৭ টাকা) অর্থাৎ, দিনে সারা শহরে প্রায় ৩৮ লক্ষ টাকার গুটখার পিক পড়ে! সংখ্যার দিক থেকে যা অবিশ্বাস্য! আর এই গুটখার পিক সর্বত্রগামী। সরকারি-বেসরকারি ভবন, উড়ালপুল, সেতু, হেরিটেজ ভবন, শৌচালয়, সিনেমা হল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল, যানবাহন, রাস্তা, ফুটপাত— গুটখার পিকের হাত থেকে নিস্তার নেই কারও। গুটখা নিষিদ্ধকরণে রাজ্য সরকারের আইন রয়েছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে অবাধেই হাতে হাতে ঘুরছে গুটখা এবং ফলস্বরূপ শহর ভেসে যাচ্ছে গুটখার পিকে। ক্ষতি হচ্ছে শরীরেরও, জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
প্রসঙ্গত, গ্যাটস-এর সমীক্ষাকেই তামাক সংক্রান্ত যে কোনও তথ্যের বিষয়ে প্রামাণ্য হিসেবে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। ‘গ্লোবাল টোব্যাকো সার্ভিল্যান্স সিস্টেম’ (জিটিএসএস)-এর অধীনে ২০০৭ সালে সারা বিশ্বে প্রথম বার এই সমীক্ষা চালু হয়েছিল। এ দেশে প্রথম বার এই সমীক্ষা হয় ২০০৯-’১০ সালে, যা গ্যাটস-১ নামে পরিচিত। আর দ্বিতীয় পর্বের, অর্থাৎ ২০১৬-’১৭ সালের সমীক্ষাতেই ধরা পড়েছে এই গুটখা-চিত্র।
ওই সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ১৯ কোটি ৯৪ লক্ষ মানুষ ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহারকারী রয়েছেন। তার মধ্যে ২৯.৬ শতাংশ পুরুষ ও ১২.৮ শতাংশ মহিলা। গ্রাম ও শহর এলাকায় ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহারকারীর হার যথাক্রমে ২৪.৬ শতাংশ এবং ১৫.২ শতাংশ।
এখন ধোঁয়াহীন তামাকের মধ্যে সব চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল খৈনি। তার পরেই রয়েছে গুটখা। ফলে ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহারের হাত ধরে এ শহরে গুটখা-লেখচিত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০০৯-’১০ সালে কলকাতায় তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যা ছিল ১৩ লক্ষ ২৮১৩। আর ২০১৬-’১৭ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লক্ষ ৬৭ হাজার ৮৩৮-এ। ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০৯-’১০ সালে যেখানে ছিল ৫ লক্ষ ৩৮ হাজার ৩৫২, ২০১৬-’১৭ সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষ ৯০ হাজার ৪৩-এ। এখানেও দেখা যাচ্ছে, অন্য মেট্রোপলিটন শহরের মতো নেশার উপাদান (স্মোকলেস টোব্যাকো) হিসেবে কলকাতাতেও সব থেকে জনপ্রিয় হল খৈনি (৬.৮ শতাংশ) এবং গুটখা (৬.৩ শতাংশ)। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর এক কর্তার কথায়, ‘‘গুটখার ব্যবহার বাড়ছে অল্পবয়সিদের মধ্যেও। কারণ, সস্তায় সহজে নেশা করা যাচ্ছে।’’ একটি ক্যানসার হাসপাতালের ডিরেক্টর তথা ক্যানসার শল্য চিকিৎসক অর্ণব গুপ্ত বলেন, ‘‘শুধু মুখের ক্যানসারই নয়, গুটখার ক্ষতিকারক উপাদান রক্তে মিশতে থাকার কারণে ফুসফুস, খাদ্যনালী, মূত্রনালীতেও ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে।’’
শুধু গ্যাটস-এর সমীক্ষাই নয়। সম্প্রতি আর একটি বেসরকারি সংস্থার তরফে করা কলকাতা ও কেরলের মধ্যে একটি তুলনামূলক সমীক্ষাতেও বিস্মিত করার মতো তথ্য উঠে এসেছে। সেই তথ্য বলছে, নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও গুটখা রাখা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে ২০১৬-’১৭ সালে কলকাতায় মাত্র এক শতাংশ দোকানে প্রশাসনের তরফে অভিযান চালানো হয়েছে। অথচ, কেরলে ১২ শতাংশ দোকানে ওই অভিযান চলেছে। এ শহরে ৬৪ শতাংশ তামাকজাত পণ্য বিক্রেতা জানেনই না, গুটখা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেরলে ৯০ শতাংশ বিক্রেতা কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। ওই সমীক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকা সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার তরফে নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে এই নেশার প্রবণতা বাড়ছে। যাদের বয়স ১৫-১৭ বছর, তাদের ৮৯ শতাংশই গুটখার মতো ধোঁয়াহীন তামাক কেনে কোনও দোকান বা কিয়স্ক থেকে। আইন থাকলেও তার ফাঁক থাকায় তা আটকানো যাচ্ছে না।’’
প্রসঙ্গত, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স নীতিতে রদবদলের জন্য চলতি বছরের শুরুতেই একটি বৈঠক হয়েছিল। পুরসভার পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে নির্মাল্যবাবুদের সংস্থার প্রতিনিধিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দার্জিলিঙের ধাঁচে কলকাতাতেও যে সমস্ত ব্যবসায়ী সিগারেট বা গুটখার মতো তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করবেন, তাঁদের বিশেষ ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে, বৈঠকে এমনই প্রস্তাব উঠেছিল। সেটি কার্যকর হলে শহরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির উপরে যেমন নিয়ন্ত্রণ আসবে, তেমনই শহরে কত জন তা বিক্রি করছেন, কোথায় করছেন, তারও একটা ঠিক হিসেব পাওয়া যাবে বলে মনে করা হয়েছিল তখন। কিন্তু সে সব এখন অতীত, জানাচ্ছেন পুরকর্তাদের একাংশ। মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার বলেন, ‘‘সেই বৈঠকে একটা প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু তার পরে আর বিষয়টি এগোয়নি।’’
ফলে ধরেই নেওয়া যায়, শহর জুড়ে গুটখার পিক চলছে, চলবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy