ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রামানুজ সিংহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন দেবাশিস বর্মণের মা।
পড়ুয়াদের মৌলিক দাবি নাকি রাজনৈতিক চাপ, গুরুত্বের ভার কোন দিকে বেশি? এর উত্তর খুঁজে না পেয়েই কি দিশাহীন কর্তৃপক্ষ? কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছাত্র অনশনের ১১ দিনের মাথায় এই প্রশ্নই তুলছে চিকিৎসক মহল।
সপ্তাহ দুয়েকের আন্দোলন, ১৬ জন ছাত্রের অনশন, ইন্টার্নদের কর্মবিরতির পরেও হস্টেল সমস্যার রফাসূত্র বার করতে পারছেন না কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ দিকে, অনশনরত পড়ুয়া অনিকেত চট্টোপাধ্যায়, সুমিত ধাড়ার পাশাপাশি শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া দেবাশিস বর্মণের। শুক্রবার দেবাশিসের মা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রামানুজ সিংহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলের বিপদ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কাও তিনি অধ্যক্ষকে জানান। তবু সমাধান মেলেনি। বরং সন্ধ্যায় বদলে যান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। দায়িত্ব যায় রেডিয়োলজি বিভাগের চিকিৎসক অশোক ভদ্রের উপরে। রাতে পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। অনশনরত পড়ুয়াদের সব অভিযোগ শুনেও তিনি জানালেন, আজ, শনিবার স্বাস্থ্য ভবনে যাবেন। অর্থাৎ, আরও এক দিন অনশনেই কাটাবেন ছাত্ররা। বন্ধ থাকবে ক্লাসও।
শুক্রবার দিনভর দফায় দফায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ডিন, সুপারের বৈঠক হয়। বৈঠক হয় রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার সঙ্গেও। কখনও শতাধিক পুলিশ ক্যাম্পাসে হাজির হয়। অভিযোগ, হাসপাতালে ছ’টি শয্যার ব্যবস্থা করা আছে বলে পুলিশের তরফে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। সবের পরেও কোনও সমাধান সূত্রের ইঙ্গিত মেলেনি কোনও তরফেই।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পড়ুয়াদের একাংশের অভিযোগ, বছর চারেক আগে শেষ হস্টেল কাউন্সেলিং হয়েছিল। তার পরে হস্টেলের আবেদন জমা পড়লেও কোনও স্বচ্ছ কাউন্সেলিং হয়নি। কর্তৃপক্ষ বারবার জানিয়েছিলেন, নতুন হস্টেল তৈরি হলে ফের কাউন্সেলিং হবে এবং আবেদনকারীরা ঘর পাবেন। নতুন হস্টেল তৈরি হলেও বর্তমান পড়ুয়াদের সমস্যার সমাধান হল না।
পড়ুয়াদের একাংশ জানান, এ বছর ১১তলা নতুন হস্টেল শুধুমাত্র প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের জন্য নির্ধারিত হওয়ার পরেই তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়ারা অধ্যক্ষ উচ্ছল ভদ্রের সঙ্গে কথা বলতে যান। হস্টেল কাউন্সেলিংয়ের নিয়ম মতো, আগে আবেদনকারীর বাড়ির দূরত্ব অনুযায়ী ঘর নির্ধারণ হবে। নতুন হস্টেলে সেই নিয়ম কেন মানা হচ্ছে না, তার কোনও উত্তর অধ্যক্ষ তাঁদের দেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, যা ভাল মনে হয়েছে সেটাই করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পড়ুয়াদের।
চিকিৎসক মহলের একাংশের মত, রাজনীতির জন্যই এই দড়ি টানাটানি। প্রথম বর্ষের পড়ুয়ারা কলেজে ভর্তির পরেই যাতে শুধু একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন, সে কারণেই নতুন ভবনটি শুধুমাত্র তাঁদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। পাশাপাশি, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার অ্যান্টি-র্যাগিং নিয়ম দেখিয়ে বর্তমান পড়ুয়াদের একাংশের সেই ভবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির চেষ্টা চলছে। অভিযোগ, নতুন হস্টেলের সুপার হিসেবে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক। অভিযোগ শুনে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান নির্মল মাজির পাল্টা বক্তব্য, ‘‘প্রশাসনের শীর্ষ স্থানে থাকা মুখ্যমন্ত্রী কিংবা আমি, সকলেই তো শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। এটা আলাদা করে বলার কী আছে? যোগ্যতা আছে, তাই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’
এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’-এর নেতা চিকিৎসক রেজাউল করিমের বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক মতামত ছেলেমেয়েদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য পড়ুয়াদের সমস্যা অবহেলা করা দুর্ভাগ্যজনক। মেডিক্যাল কলেজে কোথায় কে থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্থির করবেন। বাস্তবে পুতুল নাচের সুতো অন্য কেউ ধরে রেখেছেন।’’ পড়ুয়াদের সমর্থনে দিন দুই আগে প্রতীকী অনশনে শামিল হয়েছিলেন আর এক চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর নেতা চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে দেখার সময় পাচ্ছেন না কারণ, তাঁরা রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করেছেন।’’
আন্দোলনকারীদের সমর্থনে এ দিন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে জমায়েত করেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এসএফআই-এর ডাকে সাড়া দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি লিখিত আবেদনে সই করেন বিশিষ্টজনেদের একাংশও। ছাত্রদের ১১ দিনের অনশন নাকি রাজনৈতিক চাপ, কোনটা বেশি গুরুত্ব দেবেন মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ— প্রশ্ন তা নিয়েই। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যকে অবশ্য ফোন-মেসেজ করেও উত্তর মেলেনি।
ছবি: রণজিৎ নন্দী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy