চিকিৎসকের সঙ্গে ক্যানসার বিজয়িনীরা। নিজস্ব চিত্র
রহিমার তৃতীয় সন্তানটি তখনও স্তন্যপান করে। এক দিন ছেলেকে খাওয়াতে গিয়ে রহিমা অনুভব করেন স্তনে কাঁটার মতো কিছু রয়েছে। খারাপ কিছুর আশঙ্কা করে কুলতলি থানার পূর্ব তেঁতুলবেড়িয়া গ্রামের আটপৌরে বধূ একাই পৌঁছে গেলেন কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা ওষুধ দিলেন, খেলেনও তিনি। বার কয়েক এমন চলল। অবশেষে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানালেন, তিনি ক্যানসার আক্রান্ত নন। সন্তুষ্ট হলেন না রহিমা নস্কর। কারণ তত দিনে নিজের ‘বন্ধু’র থেকে স্তন ক্যানসার নিয়ে অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলেন তিনি।
স্বামীকে চাষের কাজে সাহায্য আর সংসার সামলানোর মাঝে অবসর পেলেই রহিমা বসে পড়তেন তাঁর পরম বন্ধু ছোট্ট রেডিয়োটি নিয়ে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রহিমার স্বাস্থ্যের পাঠ মিলেছিল সেখানেই। রেডিয়োয় ফের শুরু হল স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার অনুষ্ঠান। বলতেন, এসএসকেএম-এর এক চিকিৎসক। এসএসকেএম কোথায়? জেনে নিয়ে একাই সেখানে চলে যান রহিমা। কয়েক বারের ছোটাছুটিতে দেখা মেলে রেডিয়োর সেই চিকিৎসকের। চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। অস্ত্রোপচারে বাদ গেল রহিমার একটি স্তন। বর্তমানে অনেকটা সুস্থ রহিমার আক্ষেপ, ‘‘অসুখ ধরতে দেড়টা বছর লেগে গেল! এ জন্য রোগটাও বেড়ে গিয়েছে। জানি না কত দিন বাঁচব। বাচ্চাগুলো বড্ড ছোট।’’ এখন তিনি নিজেই গ্রামের ‘স্বাস্থ্য-মুখিয়া’। কারও কোনও সমস্যা হলেই তাঁরা চলে আসেন রহিমার কাছে।
আরও এক অসাধ্য সাধন করেছেন বছর পঁচাশির পবিত্রকুমার রায়। ২০১৩ সালের মার্চে তাঁর মলদ্বারে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। অস্ত্রোপচার করে মলদ্বারের খানিকটা বাদ দেওয়ার পরে সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে যায় একটি ব্যাগ। সেটি নিয়েও কোনও অস্বস্তিতে না ভুগে অস্ত্রোপচারের দু’মাসের মাথায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত দূরশিক্ষার পাঠ্যক্রমে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। তা-ও আবার ম্যাট্রিকুলেশনের ৬৬ বছর পরে! পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পবিত্রবাবু এর পরে স্নাতকোত্তর করেন এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়েও। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘‘আমার উপস্থিতির হার ছিল একশো শতাংশ। স্বপ্নটা ছিলই। তবে বাবার বেছে দেওয়া পথে হাঁটতে গিয়ে চাপা পড়ে গিয়েছিল। স্ত্রী এবং চিকিৎসক মেয়ের উৎসাহে ফের শুরু করেছিলাম পড়াশোনা।’’
রহিমা এবং পবিত্রবাবুর এই লড়াইকে সম্মান জানিয়ে অন্যদের অনুপ্রেরণা দিতে আজ, রবিবার রোটারি সদনে আয়োজন হচ্ছে একটি অনুষ্ঠানের। ক্যানসার আক্রান্তদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন শিশুরোগ চিকিৎসক অগ্নিমিতা গিরি সরকার। তাঁরই সংস্থার তরফে অনুষ্ঠানে প্রায় ৩০ জন ক্যানসার আক্রান্ত মহিলা সদস্য অংশ নেবেন। প্রথমে ‘গল্প হলেও সত্যি’ পর্বে ওঁরা শোনাবেন নিজেদের লড়াইয়ের কাহিনি। যেমন সুদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। ৪৩ বছর বয়সে স্তনের ক্যানসার ধরা পড়ার পরে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন এবং হর্মোন থেরাপির সময়ে ভেঙে পড়েছিলেন। সকলকে জানাবেন, সেই তীব্র মানসিক চাপ সামলে ওঠার কথা। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মমতা প্রামাণিকের পরিবার চিকিৎসা করতে গিয়ে কী ভাবে তীব্র আর্থিক লড়াইয়ের সামনে পড়েন, শোনাবেন সেই কাহিনিও। এর পরেও থাকবে বিভিন্ন পর্ব এবং সদস্যদের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
চিকিৎসক অগ্নিমিতার কথায়, ‘‘আসলে এই সব কথা আক্রান্তদের মুখ থেকে শুনে অন্যরাও মনের জোর পাবেন। এ জন্যই এমন ভাবনা। পাশাপাশি নাচ-গানেও অংশ নেবেন সংস্থার সদস্যেরা। অর্থাৎ, ক্যানসার মানে সবটা শেষ, এমনটা নয়। বরং অন্য একটা ইনিংসের সূচনা বলা যেতে পারে। এটাই দেখাতে চাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy