Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সুরের ঠেকে এখন অন্য সরঞ্জাম

১৯৮২ সালে এলপি রেকর্ডের সম্ভার নিয়ে শুরু হয় সিম্ফনির যাত্রা। ধীরে ধীরে দোকানের খ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছিল কলকাতার বাইরেও। সেই ইতিহাস ম্লান হওয়ায় অস্তিত্ব রক্ষায় পাল্টে গিয়েছে দোকানের চরিত্র।

পরিবর্তন: এ ভাবেই বদলে গিয়েছে দোকানের সরঞ্জাম। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

পরিবর্তন: এ ভাবেই বদলে গিয়েছে দোকানের সরঞ্জাম। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দীক্ষা ভুঁইয়া
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৯ ০২:০৭
Share: Save:

লম্বা দোকানের বাইরে সাজানো বিভিন্ন আকারের জলের বোতল, কাঠের কারুকাজ করা ট্রে, প্রেশার কুকার, কড়াই-সহ রান্নাঘরের নানা সরঞ্জাম। দোকানের ভিতরে এ সবের পাশাপাশি রয়েছে ডিজিটাল সরঞ্জাম। ধর্মতলা মোড়ের কাছে মেট্রো সিনেমা লাগোয়া এই দোকানের বর্তমান ছবি দেখে হোঁচট খাবেন না এমন বাঙালি কম মিলবে। কারণ, এ দোকানের সঙ্গে জড়িয়ে বহু মানুষের স্মৃতি। ‘এম বিশ্বাস অ্যান্ড সিম্ফনি’ যার পোশাকি নাম।

এই দোকানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গানপাগল মানুষের স্মৃতিমেদুর কাহিনি। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গানের লং প্লেয়িং (এলপি) রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি-র বদলে এই দোকানের একটি বড় অংশ জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে রান্নাঘর এবং ডিজিটাল সরঞ্জাম!

১৯৮২ সালে এলপি রেকর্ডের সম্ভার নিয়ে শুরু হয় সিম্ফনির যাত্রা। ধীরে ধীরে দোকানের খ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছিল কলকাতার বাইরেও। সেই ইতিহাস ম্লান হওয়ায় অস্তিত্ব রক্ষায় পাল্টে গিয়েছে দোকানের চরিত্র। তাই দোকানের একাংশে টিম টিম করে কিছু সিডি-র সার চোখে পড়লেও, বাকি অংশে জায়গা করে নিয়েছে ডিজিটাল আর রান্নাঘরের সরঞ্জাম।

এই পরিবর্তনে যেমন অখুশি অনেক সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ, তেমনই চরিত্র বদলে কোথাও ব্যথিত দোকানের কর্মচারী থেকে মালিক। তাঁদের দাবি, অস্তিত্ব রক্ষায় বাধ্য হয়ে মেনেছেন এই পরিবর্তন। কারণ, ডিজিটাল যুগে শ্রোতারা মুখ ঘুরিয়েছেন রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি থেকে।

তবে এখনও কোথাও টান রয়ে গিয়েছে গান শোনার ঐতিহ্যে। তাই বিক্রি তলানিতে ঠেকলেও দোকানের এক দিকের ফালি অংশে এখনও উঁকি মারছে বেগম আখতার, রবিশঙ্কর, আল্লারাখা কিংবা আলাউদ্দিন খানের এলপি রেকর্ড থেকে সিডি। সে সবের ক্রেতা নেই বললেই চলে। যাঁরা দোকানে ঢুকছেন, চলে যাচ্ছেন পাশের অংশে। কেউ ইউএসবি কেব্‌ল কিনতে, কেউ ঠান্ডা রাখার জলের বোতলের বা অন্য জিনিসের খোঁজে।

কেন বদলাল দোকানের সেই ছবি?

দোকানের মালিক প্রেম গুপ্ত শোনালেন এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৮২ সালে এম বিশ্বাস অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে দোকানটি কিনে নেন তিনি। শর্ত ছিল একটিই। দোকানের নাম বদল করা যাবে না। মেনে নিয়েছিলেন এই শর্ত। তবে বদল ঘটিয়েছিলেন সরঞ্জামে। সেই সময়ে সেটি ছিল বন্দুক-কার্তুজের দোকান। কিন্তু সেই ব্যবসা বদলে ফেলেন। প্রেমের কথায়, ‘‘ইংরেজি ‘গান’ (বন্দুক) থেকে আমি বাংলা গানের সম্ভারে বদলে ফেলি দোকানকে।’’ কিন্তু ইদানীং কয়েক বছর ধরে ইন্টারনেট পরিষেবা সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসায় কমে গিয়েছে রেকর্ড এবং সিডি বিক্রির সংখ্যা। তাই বাধ্য হয়ে বদলাতে হয়েছে দোকানের একাংশ। এই পরিবর্তন যে শুধু গানপাগল মানুষের মনে দাগ কেটেছে তা নয়, প্রেমও এতে খুশি নন। তাঁর দাবি, ‘‘যতই ইউ টিউব কিংবা নানান অ্যাপে গান শুনুন না কেন মানুষ, এক দিন ফের তাঁরা পুরনো এলপি রেকর্ড এবং সিডি-তে ফিরবেন। কারণ, ওই দুই গানের মাধ্যমে সুর আর বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনার যে মায়া জড়ানো ছিল তা ডিজিটালে মেলে না।’’ তাঁর দাবি, দ্রুত পুরনো এলপি রেকর্ড আর সিডি নিয়ে ফিরবে সিম্ফনি। কম দামে এল পি রেকর্ড এবং প্লেয়ার তৈরির ভাবনা করছে সংস্থাগুলি।

সিম্ফনি তাদের দোকানগুলির চরিত্রে কিছু বদল আনলেও রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড় সংলগ্ন মেলোডি বদলেছে অন্য ভাবে। সেখানে এখনও সার দিয়ে ক্যাসেটের সম্ভার। বাইরে থেকে ক্যাসেট ঠিকই, ভিতরে তাতেই পেন ড্রাইভের ডিজিটাল বার্তা রয়েছে। যার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকশো বা হাজার খানেক গান। এখানে ক্যাসেট কথা বলে জিবি-তে। ক্যাসেটের নতুন এই চরিত্র আসলে সময়ের সঙ্গে তাল রাখতে, জানালেন দোকানের কর্মচারীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘রেকর্ডিং কোম্পানিগুলি এখন সিডি বিক্রি হচ্ছে না বলে পেন ড্রাইভ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। না হলে ইউ টিউবের যুগে ব্যবসা তুলে দিতে হবে।’’

বছর কয়েক আগে ক্রেতার অভাবে এক সময়ে ব্যবসাই গুটিয়ে ফেলেছিল মিউজিক ওয়ার্ল্ড। সিম্ফনি বা মেলোডি তো তা-ও চরিত্র আংশিক বা পুরো বদলে টিকিয়ে রেখেছে। ইতিহাস আর বর্তমানের মাঝে রয়েছে বিনিসুতোটুকু। বাকিটা ..।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Music Store Esplanade
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE