Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Junglemahal

‘ঘুরে না দাঁড়ালে বেইমানি হবে যে!’ একুশের আগে চোখ ছলছল চুনা-কালীর

গ্রাম পঞ্চায়েত আর পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে যে ভাবে ধাক্কা খেতে হয়েছে পঞ্চায়েতে, তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না কালী, কল্যাণী, প্রতিমা, চুনা, ধীরেনরা। হইহই করে সবাই মিলে এসেছেন কলকাতায়, এসেছেন জেলার নানা প্রান্ত থেকে।

ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে জঙ্গলমহল থেকে আসা তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা।

ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে জঙ্গলমহল থেকে আসা তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৮ ০২:৪১
Share: Save:

সার সার চাদর, তোয়ালে, গামছা, বস্তা, মাদুর, শীতলপাটি, শতরঞ্চি। কোনওটা লম্বালম্বি, কোনওটা আড়াআড়ি, কোনওটা যাতায়াতের জন্য রাখা একফালি ফাঁকা জায়গাটার সঙ্গে সমান্তরাল। যেন নানান জ্যামিতি বিভিন্ন রঙে চিত্রিত। আর সে সব জ্যামিতিক রেখার উপরে অপেক্ষায় শ’য়ে শ’য়ে। অপেক্ষা একুশের সকালটার জন্য।

পাখি সরেনও উবু হয়ে বসে ছিল ওই রকমই একটা জ্যামিতিক রেখার উপরে। সদ্য কিশোরী, ক্যামেরা দেখেই মুচকি হেসে নামিয়ে নিল লাজুক মুখ। আলতো ঠেলা দিল পাশে বসা মধ্যবয়সী মহিলাকে। কিন্তু তিনিও সাবলীল নন। অগত্যা পাঁচ-ছ হাত দূর থেকে উঠে এলেন কল্যাণী মুর্মু। বললেন, ‘‘আমাদের মালিক আছে, ডেকে দিব?’’ ‘মালিক’? তিনি কে? ‘মানে যে আমাদের লিয়ে এসিছে।’ এক গাল হেসে বলেন কল্যাণী।

ডাকতে হল না ‘মালিক’কে। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা তাঁর গাঁয়ের লোকজনের সামনে ঘোরাফেরা করছে, দূর থেকেই দেখে নিয়েছেন কালীপদ মুর্মু। তাই নিজেই চলে এলেন। তবে কোনও মাতব্বরির ভঙ্গি নেই সে আগমনে, চোখেমুখে চেনা সারল্য আর জিজ্ঞাসা। কোন ব্লক?কালীপদ জানালেন, রঘুনাথপুর। গোটা পুরুলিয়া থেকে তাও কত লোক এলেন? কালীপদ মুর্মু বললেন, ‘‘তা অনেক হবে, একটা ট্রেনেই আমরা সবাই এসছি, রূপসী বাংলা। পুরো ট্রেনটায় শুধু আমরাই (তৃণমূল সমর্থকরা) ছিলাম।’’

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের ‘অঙ্গীকার’ করবেন দলনেত্রী, অপেক্ষায় একুশের সমাবেশ

নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম আর ইডেন গার্ডেন্সের মাঝে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের ছবিটা এখন এই রকমই। এক টুকরো জঙ্গলমহল যেন। স্ট্র্যান্ড রোড বা হাইকোর্ট চত্বর বা আকাশবাণী ভবনের কোনা— যে কোনও দিক থেকে তাকালেই ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে ঢোকার মুখে জমজমাট ব্যস্ততা টের পাওয়া গিয়েছে শুক্রবার দিনভর। তবে ব্যস্ততা শুক্রবার থেকে নয়, তারও ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে। উত্তর কলকাতা যুব তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি সৌম্য বক্সী বললেন, ‘‘বাইশশোর মতো কর্মী-সমর্থককে রাখা হয়েছে ক্ষুদিরামে। অধিকাংশই পুরুলিয়া বা জঙ্গলমহল থেকে। দুই দিনাজপুর থেকেও কিছু আছেন।’’

দেখুন ভিডিয়ো:

বলাই বাহুল্য, এঁরা সকলেই এসেছেন একুশে জুলাইয়ের শহিদ স্মরণ সমাবেশে যোগ দিতে। দূরের জেলা থেকে আসা কর্মী-সমর্থকদের জন্য শহরের যতগুলি জায়গায় থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র সেগুলির অন্যতম। বড় ঢালাও হলঘর ঠিকই। কিন্তু ভিতরে ঢুকলে টের পাওয়া যাচ্ছে, জমায়েতটা হলঘরের চেয়েও বড়। আড়াই দিন ধরে, সেখানেই থাকা, সেখানেই বসা, সেখানেই শোওয়া, সেখানেই ঘুম থেকে ওঠা। শুধু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটা পিছন দিকের ফাঁকা চত্বরটায়। শোওয়া-বসার জায়গায় ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতাটা ধরে রাখার জন্যই খাওয়া-দাওয়াটা বাইরে সারার ব্যবস্থা হয়েছে।

এঁরা সকলেই এসেছেন একুশে জুলাইয়ের শহিদ স্মরণ সমাবেশে যোগ দিতে। থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে।

সন্ধে তখন সবে গড়িয়েছে রাতের দিকে। খুব জোর পৌনে আটটা। গোটা হল জুড়ে ধীরে ধীরে চঞ্চলতা বোঝা যেতে শুরু করল। দু’দিন কেটে গিয়েছে কলকাতায়। দিনের বেলা কেউ কেউ একটু শহর ঘুরে দেখেছেন। কিন্তু বিকেল বিকেলই সব্বাই ফের ঢুকে পড়েছেন অস্থায়ী আস্তানায়। রাত নামলে শহরটার নাকি রূপ বদলে যায়, চেনা যায় না আর, ‘ভুলোয়’ ধরে, দিক ভুল হয়ে যায়— পুরুলিয়া থেকেই শুনে এসেছেন চুনা হাঁসদা, ধীরেন হাঁসদারা। তাই বিকেলের আলো মোছার আগেই নগর-দর্শন সেরে নিয়েছেন তাঁরা। সন্ধে থেকে হলের নানা প্রান্তে ছোট ছোট জটলা। কোথাও একটু গল্প-গাছা, কোথাও একটু শহুরে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া, কোথাও অলস ভঙ্গিতে আধশোয়া এক দঙ্গল ছেলে-ছোকরা কোনও একজনের স্মার্ট ফোনে বুঁদ। কিন্তু সাড়ে সাতটার পর থেকেই আসরগুলো চঞ্চল হতে শুরু করল। সব চোখ অফিস ঘরটার দিকে। রাতের খাওয়ার ডাক পড়ার অপেক্ষা আসলে। শহিদ স্মরণে আড়াই-তিন দিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন বটে। কিন্তু রোজকার অভ্যাস কি আর তাতে বদলায়? রঘুনাথপুর, কাশীপুর, বলরামপুর, পারা, মানবাজারের প্রত্যন্ত বা প্রত্যন্ততর গ্রামগুলোয় সন্ধে নামার খানিক পরেই তো এ ভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে জীবন রোজ। এখনও।

কালীপদ মুর্মু অবশ্য অন্য কথা শোনালেন। জঙ্গলমহলের অনেক গ্রামেই এখনও সূর্য ডুবলেই জীবনও ডুবে যায় ঠিকই। কিন্তু আগের চেয়ে অনেক বদলেছে পরিস্থিতি, দাবি তাঁর। কী বদলেছে? ‘‘ঢালাই রাস্তা করে দিয়েছে, সোলার বাতি দিয়েছে, জলের ব্যবস্থা করেছে, ঘর দিয়েছে, দু’টাকা কেজি চাল দিয়েছে, সাইকেল দিয়েছে, ছেলে-পুলেদের বই দিয়েছে, জুতো দিয়েছে।’’ কড় গুণে বলে চলেন কালী। কিন্তু বাংলার যে কোনও প্রান্তে যে কোনও তৃণমূল কর্মীই তো এই কথাগুলোই বলেন, এ তালিকা তো এখন সবার মুখস্থ। সত্যিই সবাই সব পেয়েছেন? কালী চকিতে সঙ্গীদের দিকে ফিরে যান, সবাই সব পেয়েছেন কি না, তাঁদেরই বলতে বলেন। প্রায় সমস্বরে প্রত্যেকে সম্মতি জানান। কেউ কেউ কালীর তালিকার বাইরে থেকে যাওয়া দু’একটা প্রাপ্তির কথাও মনে করিয়ে দেন।

এতই যখন দিলেন ‘দিদি’, পুরুলিয়ায় পঞ্চায়েত ভোটে কেন ধাক্কা খেতে হল তৃণমূলকে? প্রশ্নটা উঠতেই গলা ধরে আসে কালীপদ মুর্মুর, ‘‘হই গিইছে খারাপ কোনও কারণে। একটা রব উঠে গেইছিল...।’’ মাথা নীচু, চোখ দেখা যায় না আর, তবে বাষ্পাকূল হয়ে ওঠার আভাস। এত আবেগ! তৃণমূলের খারাপ ফলের প্রসঙ্গ আসতেই এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন কালীপদ! আট বছর মসনদে কাটিয়ে দেওয়ার পরেও একটা দলের জন্য কর্মীর মনে আবেগের এত আধিক্য খুব কম কথা নয়।

প্রশ্নটা এ বার অন্য ভাবে করতে হল তাই। পঞ্চায়েতে খারাপ ফল হওয়া সত্ত্বেও তো অনেক লোকই পুরুলিয়া থেকে এসেছেন দেখছি, কী মনে হচ্ছে? পারবেন ঘুরে দাঁড়াতে? নিমেষে মুখ তোলেন কালীপদ। ‘‘হ, ঘুরে দাঁড়াব। নিস্‌চই ঘুরে দাঁড়াব।’’ কী ভাবে? খুব স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেন না রঘুনাথপুর থেকে জনা পঞ্চাশেক লোকের ‘মালিক’ হিসেবে কলকাতায় আসা বছর চল্লিশেকের কালীপদ। কিন্তু ২০১১-র আগের বেশ কয়েক বছর জঙ্গলমহলে কী দিন দেখেছেন, আজ আর আজ কী পরিস্থিতিতে বাঁচছেন, তার একটা তুলনা তুলে ধরার চেষ্টা করেন প্রাণপণে।

কালীপদ মুর্মু কিন্তু একা নন। তিনি ঠিক যে ভাবে মরমে মরে আছেন, একুশের সমাবেশে যোগ দিতে পুরুলিয়া থেকে আসা প্রত্যেক তৃণমূল কর্মীর অবস্থাই যেন সে রকম। জেলা পরিষদ তো আর হাতছাড়া হয়নি, কিসের ধাক্কা? পুরুলিয়া প্রসঙ্গে তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্ব বার বার এ কথাই বলছেন। কিন্তু জেলার কর্মী-সমর্থকদের আক্ষেপ তাতে বিন্দুমাত্র কমছে না। গ্রাম পঞ্চায়েত আর পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে যে ভাবে ধাক্কা খেতে হয়েছে পঞ্চায়েতে, তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না কালী, কল্যাণী, প্রতিমা, চুনা, ধীরেনরা। হইহই করে সবাই মিলে এসেছেন কলকাতায়, এসেছেন জেলার নানা প্রান্ত থেকে। শনিবার হইহই করেই সামিল হবেন সমাবেশে। কিন্তু পঞ্চায়েতের ক্ষত যে একটুও শুকোয়নি, নির্বাচনী ফলাফলের প্রশ্নটা একবার তুললেই তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

আরও একটা আশ্চর্য মিল পুরুলিয়া থেকে আসা প্রায় সবার মধ্যে। ভোটে কেন খারাপ হল ফলাফল? প্রশ্নটা শোনা মাত্রই চোখটা সরিয়ে নিচ্ছেন পুরুলিয়ার তৃণমূল কর্মীরা। তার পর একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলছেন, ‘‘হই গিইছে কোনও কারণে।’’ তবে পরক্ষণেই প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো করে তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, পুরুলিয়ায় দলের এ ক্ষতি স্থায়ী নয়, পরিস্থিতি ঘুরবেই। যদি না ঘোরে? চুনা হাঁসদা বলেন, ‘‘বেইমানি হই যাবে তো তা হলে! জঙ্গলমহল তো বেইমানি করতে জানে না।’’

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE