Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা পথের মধ্যিখানে

কোথায় বাসস্টপ, কেউ জানেন না! কিংবা জানলেও বাসস্টপের পরোয়া করেন না। যত্রতত্র বাস থামিয়ে ওঠা বা নামাটাই যেন কলকাতার ট্রাফিক-সংস্কৃতি। ঘুরে দেখলেন ঋজু বসু ও সৌভিক চক্রবর্তী।দু’দিন আগে নামী বেসরকারি হাসপাতালের উল্টো দিকে হুট করে থেমে যাওয়া বাসের পিছনে ধাক্কা খেয়ে তুবড়ে গিয়েছিল একটি স্কুলগাড়ি। জখম হয় পাঁচ জন পড়ুয়া। বৃহস্পতিবার দুপুরেও আর একটু হলেই একই ঘটনা ঘটছিল। এক বৃদ্ধ হাত দেখাতেই বাসটা থেমে গিয়েছিল।

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪৭
Share: Save:

• ই এম বাইপাস (কাদাপাড়ার মোড়ের কাছে): দু’দিন আগে নামী বেসরকারি হাসপাতালের উল্টো দিকে হুট করে থেমে যাওয়া বাসের পিছনে ধাক্কা খেয়ে তুবড়ে গিয়েছিল একটি স্কুলগাড়ি। জখম হয় পাঁচ জন পড়ুয়া। বৃহস্পতিবার দুপুরেও আর একটু হলেই একই ঘটনা ঘটছিল। এক বৃদ্ধ হাত দেখাতেই বাসটা থেমে গিয়েছিল। পিছনে ধাবমান আর একটি বাস কোনওমতে ব্রেক কষে সামলে নিল। ‘বাস বে’ আঁকা রয়েছে পরিপাটি। কিন্তু তা কার্যত ব্রাত্য। বাইপাসে বাস একটু বেশিই জোরে চলে। সেখানে এই খেয়াল-খুশির বাসস্টপের রেওয়াজ বিপজ্জনক মানছেন পুলিশকর্মীরা।

• বি বা দী বাগ: বাসস্টপটা কোথায়? ‘ওই তো লেখা আছে, বাস উইল নট স্টপ হিয়ার!’ না, ছাপার ভুল নয়। বি বা দী বাগ (ইস্ট) ও ম্যাঙ্গো লেনের সংযোগে ট্রাফিক পুলিশের গুমটিতে কর্তব্যরত কনস্টেবলকে প্রশ্ন করতে এই জবাবই মিলল। সিগন্যালের অদূরেই বাসের ছবি এঁকে পুলিশের সাইনবোর্ড স্পষ্ট বলছে, বাস এখানে থামবে না! আর ঘটছে ঠিক উল্টোটা। বাসের জন্য অপেক্ষমান জনতা ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তার মঝখানে উঠে এসেছে। মহাকরণের সামনে থেকে কার্জন পার্ক অবধি গোটা রাস্তায় প্রকৃত ‘বাসস্টপ’ কোথায়, কেউ জানে না। কিন্তু বাস থামছে সর্বত্র। মহাকরণের পাশের গির্জার সামনে হাও়ড়ার দিক থেকে আসা বাসের ঢল নিয়ম ভেঙেই থামছে। লোকে উঠছে। এক কোণে লালবাজারের মস্ত বাড়িও অসহায় ভাবে ওই দৃশ্যের সাক্ষী।

• লেনিন সরণি-জওহরলাল নেহরু মোড়: দেখে কে বলবে, বাসস্টপ ওই চত্বর থেকে বেশ কয়েক পা দূরে?

যাত্রী তুলতে সটান বাস থামিয়ে রাস্তায় নেমে দাঁড়ালেন কন্ডাক্টর। গলার শিরা ফুলিয়ে হাঁকডাক শুরু, ‘এ-ই মৌলালি, শিয়ালদহ, রাজাবাজার’! লেনিন সরণির উপরে ধর্মতলার মোড়ে এ দৃশ্য দেখা গেল ভরদুপুরে। বাসস্টপ ওই তল্লাট থেকে আরও খানিকটা দূরে সাবেক ‘নিউ সিনেমা’ হলের কাছে। কিন্তু ধর্মতলার ওই মোড়টায় দিনে-রাতে যে কোনও সময়ে বাস থামানোটাই অলিখিত নিয়ম। জওহরলাল নেহরু রোডের উপরে এস এন ব্যানার্জির মোড় অবধি দক্ষিণমুখী বাস এ ভাবেই একেবারে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে সওয়ারি তোলে। পুলিশ দেখেও দেখে না। পুলিশের মুখে, ওই চত্বরের ডাকনাম ‘নো সার্জেন্টস জোন’। মানে ওখানে বাসকর্মী বা যাত্রীদের ‘ভাবাবেগে’ ঘা দিয়ে পুলিশ এতটুকু গা-ঝাড়া দিতে রাজি নয়।

• শিয়ালদহ: উত্তর কলকাতা থেকে বাসটা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে আসতেই নামার জেদ ধরলেন ষণ্ডামার্কা যুবক। বাস থেমেও গেল সঙ্গে-সঙ্গে। শুধু ওখানেই নয়, শিয়ালদহ-চত্বরে উড়ালপুল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু করে মৌলালি অবধি বাস থামিয়ে লোক নামানোর বা লোক তোলার কোনও ধরাবাঁধা জায়গা নেই। সবটাই বাসকর্মী বা যাত্রীদের মর্জি! দুমদাম রাস্তার মাঝে বাসে উঠতে বা নামতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে চলেছে। তাতেও পুলিশ বা পথচারী কারও কোনও রকম পরোয়া নেই।

• উল্টোডাঙা মোড়: ‘বাস এখানে থামবে না’ বলে বাংলায় লেখা বোর্ডটা যেন আস্ত ঠাট্টা। উল্টোডাঙা স্টেশনের উল্টোদিকে এবং উড়ালপুলে ওঠার মুখটায় যাত্রীদের ভিড়। বাস, অটো— সবই ইচ্ছে মতো থামছে। লোকেও নির্বিকার। কর্তব্যরত পুলিশকর্মী দর্শকের ভূমিকায়। কেন? প্রশ্ন করতে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘বিশ্বাস করুন, মাঝেমধ্যে বাস-অটোর নামে কেস করি তবু কারও হুঁশ ফেরে না।’’

• রাসবিহারী মোড়: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের উপরে সিমেন্টে বাঁধানো ‘যাত্রী প্রতীক্ষালয়’ সাকুল্যে দু’জন খোশগল্পে মত্ত। ফুট বিশেক দূরে মোড়ের মাথায় বাস ধরার হুড়োহুড়ি। সাঁ-সাঁ করে এগোন বাস দুম করে থামছে। যাত্রীরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে উঠছেন। ‘এখানে তো বাস দাঁড়ানো বারণ, আপনারা দাঁড়াচ্ছেন কেন?’ জবাবে হাওড়া নাকতলা রুটের একটি বাসের কন্ডাক্টর বলেন, ‘‘সকলে দাঁড়ায়, তাই দাঁড়াচ্ছি। আপনার কী?’’

• লালবাজার উবাচ: শুধু কয়েকটি মোড় নয়। এ রোগ কলকাতাময় ছড়িয়ে পড়েছে। কলকাতা পুলিশের এক ট্রাফিক-কর্তার আক্ষেপ, ‘‘বাস, অটোর বিরুদ্ধে না হয় কেস লেখা হল, কিন্তু যাত্রীদের বোঝানো মহা সমস্যা। এই বেনিয়ম বন্ধ করতে গেলে কলকাতায় সব কাজ ফেলে শুধু এই ব্যাপারটা নিয়েই পড়ে থাকতে হবে, তা কি সম্ভব?’’ পুলিশ সূত্রের খবর, ‘বাস, অটো বা ট্যাক্সি কারওরই মোড়ের ৩০ মিটারের মধ্যে থামার কথা নয়। এই নিয়ম না মানলে ১০০ টাকা জরিমানা হওয়ার কথা। দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার একই দোষ করলে সেই জরিমানা বেড়ে ২০০-২৫০ টাকাও হয়। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। যে কোনও ট্রাফিক গার্ডেই ভুল জায়গায় গাড়ি বা বাস থামানোর অভিযোগে দিনে ১০০-২০০টা ‘কেস’ লেখে পুলিশ। তবে দিনভর অনিয়মের যে চিত্র দেখা গেল, তার তুলনায় এই সংখ্যা সামান্যই।

কিন্তু জেব্রা ক্রসিং ধরে ঠিকঠাক রাস্তা পারাপার শেখাতে যদি পথচারীদের মধ্যে নানা ভাবে সচেতনতা-অভিযান চালায় পুলিশ, যেখানে-সেখানে বাসে ওঠা ঠেকাতেই বা কেন নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করা যাবে না? লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘এ কাজের জন্য বাড়তি লোক দরকার। তবে কয়েক বছর আগে বাসস্টপ থেকে বাসে ওঠার নিয়ম শেখাতেও নাগরিকদের সচেতন করার চেষ্টা হতো। ইদানীং তা সে-ভাবে করা যাচ্ছে না।’’ কেন? লালবাজারের কর্তাদের কাছে সদুত্তর মেলেনি। ট্রাফিক গার্ডে গার্ডে অবশ্য রসিকতা চলে, ‘ধুর ধুর মশা কি মেরে শেষ করা যায়!’

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য ও বিশ্বনাথ বণিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE