বেমানান: গির্জার সামনে তৈরি হয়েছে পার্কিং-লট। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ভরদুপুরের কিচিরমিচিরময় হাইকোর্টপাড়া এমন ঘোর মিথ্যে মনে হবে কে ভেবেছিল।
একদা দেশের প্রাচীনতম কোর্টের সামনে কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিট ধরে ডাইনে বেঁকে কয়েক পা এগিয়েই পাঁচিলঘেরা বাগান। তাতে সেঁধিয়ে গেল যুগল। কল্লোলিনীর দিনগত পাপক্ষয়ের ক্লেদ তার পরেই মুছে যাবে।
মাথাপিছু ১০ টাকায় শহর কলকাতায় এমন নির্জনতার খোঁজ মেলে, অনেকেই জানেন না। দূরের পর্যটকেরা তো সাধারণত শীতেই আসেন। কিন্তু বিক্ষিপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকা, ফটোশিকারী বা কোনও ভ্রাম্যমাণ একা চ্যাপলিন ঘুরেফিরে এ তল্লাটে আসে! ছেলেটিকে হয়তো হাইকোর্ট পাড়ায় নিয়মিত আসতে হয়। মেয়েটিও অফিসপাড়ার কর্মী। মাঝেমধ্যে মিলে যায় অবসর। তখনই মনে পড়ে, সেন্ট জন্সের গির্জা লাগোয়া চত্বরকে। বড়বাজারের আর্মানি গির্জা বা মিশন রো-এর ওল্ড মিশন চার্চের পরেই বয়সে এগিয়ে এই গির্জা। রাজা নবকৃষ্ণ দেব জমি দিয়েছিলেন কোম্পানিকে। ওয়ারেন হেস্টিংস ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর গির্জা চালু হল ১৭৮৭ সালে। লোকে ডাকত পাথুরে গির্জা। এত পাথর না কি গৌড় মানে মালদহ থেকে আনা হয়েছিল। ১৭৪ ফুট উঁচু পাথুরে চুড়ো গির্জার মাথার মুকুট।
শুধু তো গির্জা নয়, কলকাতার সেই শৈশবের বেশ কিছু বিশিষ্ট মৃত্যুরও স্মারক এ তল্লাটে। তবে জোব চার্নকের সমাধি সৌধের আবডাল নয়, আর একটু ফাঁকায় সাদাটে বেদীটায় বসতেই বরং ভাল লাগে এখন।
ওটা কি সেই বিতর্কিত ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডির ‘স্পট’? পলাশির যুদ্ধের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে টক্করের সময়ে ফোর্ট উইলিয়মের যে ঘুপচি ঘরে শ’খানেক বন্দি ব্রিটিশকে ঠেসে দম আটকে মেরেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা? ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে ইতিহাসবিদদের সংশয় আছে। কিন্তু সেন্ট জন্সের গির্জা-চত্বর বহন করছে সেই ইতিহাসের স্মারকও। বড়লাট কার্জনের আমলে তৈরি বেদীটায় বসলে পায়ের উপরে চকিতে হেঁটে যায় আদুরে কাঠবেড়ালি। সামনেই পাতাবাহারের কলাম। চারপাশে, শাল-সেগুন-আম-জামের ভিড়।
এই বেদীর বাঁ পাশেই শুয়ে একদা ছোটলাট লর্ড ব্রেবোর্ন। আর বাগানের আরও ভিতরে এগোলেই আঠেরো শতকে রোহিলা যুদ্ধে নিহত কোম্পানির সেনানীদের স্মারক, কিংবা জোব চার্নকের সমাধিসৌধ। আঠেরো শতকের মাঝামাঝি অবধি এই চত্বরেই ছিল কলকাতায় সাহেবদের একমাত্র সমাধিক্ষেত্র। ল্যাটিনে খোদাই চার্নকসাহেবের কবরের সামনে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে আরও ভিতরে ঢুকলেই বুড়ো বটের ঝুরির সামনে আর একটি গোলাকার সৌধ। আঠেরো শতকের কলকাতার এক জাঁদরেল মেমসাহেব, বেগম জনসন ওখানে শুয়ে। ৮৭ বছরের জীবনে, রাজপুরুষ মহলে প্রবল প্রতিপত্তিধারী জনসন সাহেবাকে কলকাতার ত্রিকালদর্শী বলে ধরা হতো। প্রথম বড়লাট গিন্নি লেডি ক্যানিংয়ের একটা স্মৃতিসৌধও রয়েছে।
পথভোলা আগন্তুক আর একটু অনুসন্ধিৎসু হলে গির্জার ভিতর ঘরে বন্দি হেস্টিংস সাহেবের চেয়ারটাকেও দেখতে পেয়ে যাবেন। সাংঘাতিক পেল্লায় সিংহাসন গোছের নয়। তবে রাজমুকুটের ম্লান ছাপবিশিষ্ট পুরনো গদি দেখার মতো। গির্জায় শিল্পী জোহান জোফানির আঁকা ‘লাস্ট সাপার’ ছবিটাও দেখার মতো।
গির্জার অফিসারদের সঙ্গে গপ্পে-গপ্পে কানে আসে শিকড়ের খোঁজে আসা সাহেবদের কথা। কার ঠাকুর্দা-ঠাকুরমার বিয়ে হয়েছিল এই গির্জায়, কিংবা কার দাদুর বাবার ব্যাপটিজম। উপরের একটি ঘরে এসি বসিয়ে সে-সব নথি সংরক্ষণ চলছে কাঠখড় পুড়িয়ে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ-লেখক উইলিয়ম ডালরিম্পলও একদা হাজির হয়েছিলেন তাঁর দাদুর দাদু ব্রিটিশ রাজপুরুষ জেমস প্যাট্লের স্মৃতিফলকটি দেখতে। প্যাট্ল সাহেব না কি ‘ভারতের সেরা মিথ্যুক’ বলে খ্যাত ছিলেন। মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ রামে মজিয়ে বিলেতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হলেও জাহাজডুবি হয়। গির্জার গায়ে তাঁর স্মৃতিফলকটিও রয়েছে।
এমনিতে গাড়ির পার্কিং-লট করতে হয়েছে এই চত্বরে। গির্জার রক্ষণাবেক্ষণে যা সহায়ক। রবিবারের সার্ভিসে বেশি ভিড় হয় না এখন। কিন্তু সাবেক অর্গ্যানের সুর বেজে ওঠে। বেরঙিন সমকালকে ছুঁয়ে যায় ইতিহাসের রং।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy