Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Rare Diseases

বিরল রোগের প্রতিকারে সরকারি অনীহা, প্রতিরোধই কি ভরসা

বিয়ের সূত্রে বিহারে থাকছিলেন পার্ক সার্কাসের মেয়ে আয়েষা খাতুন। ছ’-সাত বছরের বড় মেয়েটি দিব্যি সুস্থ। তাই দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের আগে নিশ্চিন্ত ছিলেন ওই দম্পতি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

জয়তী রাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২০ ০২:৫২
Share: Save:

আর পাঁচটি পরিবারের মতোই প্রথম সন্তানের জন্মের পরে আনন্দ ছড়িয়েছিল পারেখ পরিবারে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পাঁচ মাস বয়সেই বীর নামে সেই শিশুর রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে, বিরল রোগ ‘স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি’ (এসএমএ) টাইপ-১ হয়েছে তার। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল গণেশ টকিজ় এলাকার বাসিন্দা বিশাল এবং নীতু পারেখের। হাতে সময় নেই, বুঝেছিলেন তাঁরা। তবু দুর্মূল্য ওষুধ ছেলেকে দিতে সব স্তরে লেখালেখি শুরু করেছিলেন বিশাল। ডাক্তার দেখিয়ে ফিরতেই এক দিন শুরু হয়েছিল শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালে ভর্তি করে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। আর ফেরেনি ছ’মাসের বীর।

বিয়ের সূত্রে বিহারে থাকছিলেন পার্ক সার্কাসের মেয়ে আয়েষা খাতুন। ছ’-সাত বছরের বড় মেয়েটি দিব্যি সুস্থ। তাই দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের আগে নিশ্চিন্ত ছিলেন ওই দম্পতি। কিন্তু নড়াচড়া সম্পূর্ণ বন্ধ কেন দু’মাসের অনাবিয়ার? জানতে গিয়ে ধরা পড়ে, সে এসএমএ টাইপ-১ রোগে আক্রান্ত। এর পরে আরও পাঁচ মাস পেয়েছিল অনাবিয়ার পরিবার। গত ২২ অক্টোবর চিরতরে থেমে যায় সে।

শুধু এই দুই শিশুই নয়। প্রতি বছর দেশে কার্যত বিনা চিকিৎসায় থমকে যাচ্ছে বিরল রোগের শিকার অসংখ্য জীবন। কারণ, বেশ কিছু ক্ষেত্রে কোনও চিকিৎসাই নেই। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া।
ওষুধ বা চিকিৎসা সংক্রান্ত জিনিসপত্র বিদেশ থেকে আনানো খুবই খরচসাপেক্ষ এবং তার জন্য এত কাঠখড় পোড়াতে হয় যে, তত দিনে রোগীর মৃত্যু হয়। কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা থাকলেও সময়ে রোগ ধরা না পড়াই হয়ে ওঠে মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

বিশ্বে খোঁজ পাওয়া বিরল রোগের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ভারতে এসএমএ-র মতো আরও সাড়ে চারশোটি বিরল রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। যার মধ্যে অনেকগুলি এতই অপরিচিত যে, চিকিৎসকেরাও চিনতে পারেন না। ফলে প্রতিকার ও প্রতিরোধের অভাবে দেশের প্রায় দশ কোটি জনসংখ্যা বিরল রোগে আক্রান্ত।

এ বিষয়ে সরকারি স্তরে নির্দিষ্ট তথ্যভাণ্ডার না থাকাটা চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে অনেকটাই পিছিয়ে দিচ্ছে। অথচ প্রতিরোধের কাজে সেটা জরুরি বলেই মনে করছেন আক্রান্তদের অভিভাবক এবং চিকিৎসকেরা। ২৯ ফেব্রুয়ারি ছিল ‘ওয়ার্ল্ড রেয়ার ডিজ়িজ় ডে’। বিশাল এবং আয়েষার মতে, এক দিন নয়, বছরভর এই ধরনের রোগগুলি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা চলুক।

এসএমএ আক্রান্ত দশটি পরিবারকে নিয়ে ২০১৪ সালে ‘কিয়োর এসএমএ ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়া’র পথ চলা শুরু হয়েছিল। ওই সংগঠনের পূর্ব ভারতের কো-অর্ডিনেটর মৌমিতা ঘোষ জোর দিচ্ছেন সচেতনতার প্রসারে। সন্তানদের চিকিৎসার ওষুধ বিদেশ থেকে আনাতে নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছেন মৌমিতা। ‘অর্গানাইজেশন অব রেয়ার ডিজ়িজ়েস, ইন্ডিয়া’র এ রাজ্যের কো-অর্ডিনেটর দীপাঞ্জনা দত্তের মতে, “প্রথমেই ক্যারিয়ার স্ক্রিনিং জরুরি। তাতে যদি ধরা পড়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই এসএমএ বা কোনও বিরল রোগের বাহক, তখন পরবর্তী জরুরি ধাপ হল, প্রি-নেটাল স্ক্রিনিং করে ভ্রূণের অবস্থা জেনে নেওয়া। তাতেও কিন্তু সদ্যোজাতের বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একশো ভাগ আটকানো যায় না।”

সচেতনতার অভাবের কথা মানছেন মৌমিতা। তাঁর মেয়ে দেবস্মিতা এসএমএ-তে আক্রান্ত। তাও মৌমিতার ভাই ও তাঁর স্ত্রীর বাহক নির্ণয়ের পরীক্ষা করাতে লড়তে হয়েছে তাঁকে। শিবির, আলোচনা প্রভৃতির মাধ্যমে সচেতনতার প্রসার ও সদ্যোজাতের দ্রুত রোগ নির্ণয় করা নিয়ে কাজ করছে তাঁদের সংগঠন। বিরল রোগের ভিড়ে তা যে নিতান্তই সামান্য, মানছেন মৌমিতা এবং আক্রান্ত পরিবারগুলি।

পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট অরিজিৎ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, সরকারি সাহায্য ছাড়া এ সবের খরচ বহন করা কি সমাজের সব স্তরের মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? তাঁর পরামর্শ, “পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ বা নিজের কোনও সন্তান অজানা রোগে আক্রান্ত হলে পরবর্তী সন্তান ধারণে বাড়তি সতর্ক হতে হবে। তথ্য গোপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।”

বীরকে হারিয়ে পারেখ দম্পতি চান, রোগের সচেতনতা প্রসারে সব রকম সাহায্য করতে। বড় মেয়ের মধ্যেই আয়েষা খুঁজে যান অনাবিয়াকে।
বলে ওঠেন, “আগে জানলে পুতুলের মতো মেয়েটাকে এত কষ্ট পেয়ে
যেতে হত না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rare Diseases Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE