Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

এও এক কলকাতা! পানি-পথের যুদ্ধ জিততে বাসিন্দাদের অস্ত্র নৌকা

বিদ্যুৎ বলেন, ‘‘অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে নৌকায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন দিনও গিয়েছে।’’

জল-কাহন: অল্প বৃষ্টি হলেও এ ভাবেই যাতায়াত করতে হয় বিরাটির পূর্ব বরিশালনগরের বাসিন্দাদের।
ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

জল-কাহন: অল্প বৃষ্টি হলেও এ ভাবেই যাতায়াত করতে হয় বিরাটির পূর্ব বরিশালনগরের বাসিন্দাদের। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০২:২১
Share: Save:

নামেই কলকাতা-৪৯। তবুও এখানে সব পথ পানি-পথ! বৃষ্টিপাত মিলিমিটারে বাড়লে পানি-পথের যুদ্ধ জয়ে বিরাটির পূর্ব বরিশালনগরের বাসিন্দাদের কাছে অপরিহার্য নৌকা।

উত্তর দমদম পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কলকাতা বিমানবন্দরের দূরত্ব বেশি নয়। কাছেই দু-দু’টি এক্সপ্রেসওয়ে, কল্যাণী এবং বেলঘরিয়া। তবুও জলপথের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারেন না ছেলে। বছরভর জল জমে থাকায় এলাকার কন্যাশ্রীদের স্কুল কামাই হয়। কিশোরী মেয়ে যে ভাবে জল ঠেলে ভিজে জামাকাপড়ে স্কুলে যায় তাতে বিচলিত হয়ে পড়েন মা। প্রশ্ন করেন, স্বাধীনতার একাত্তর বছর পরেও কেন নিকাশি গড়ে উঠল না? খাতায়-কলমে পুর এলাকার বাসিন্দা হলেও ন্যূনতম পরিষেবার এই হালের জন্য বাড়িতে নৌকা কিনে রেখেছে দু’টি পরিবার।

বিদ্যুৎ আদক সেই পরিবারেরই এক জন। জমি কেনার পরে ১৯৮৪ সালে পূর্ব বরিশালনগরে বসবাস শুরু করে বিদ্যুতের পরিবার। তখন থেকেই ওই পরিবারের
যাতায়াতে ভরসা নৌকা। বিদ্যুৎ জানান, তাঁরা বসবাস শুরু করার সাত বছর পরে ১২টি পরিবার ওই এলাকা বাসিন্দা হয়। তারও সাত বছর পরে গঠিত হয় পূর্ব বরিশাল উন্নয়ন সমিতি। একাধিক বার মাপজোক হলেও সেই সমিতি গঠনের কুড়ি বছর পরেও রাস্তা তৈরি হয়নি। বাসিন্দারাই আগাছা ছেঁটে মাটি কেটে হাঁটার মতো ফালি রাস্তা তৈরি করেছেন। ভারী বৃষ্টি হলে সেই রাস্তায় কোমর সমান জল জমে যায়। এমনিতে নিকাশি না থাকায় হাঁটুর উপরে জল বছরভর থাকে। বিদ্যুৎ বলেন, ‘‘অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে নৌকায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন দিনও গিয়েছে।’’

বিদ্যুতের মতো বাড়িতে নৌকো রয়েছে দিলীপ ঘোষেরও। তাঁর মেয়ে দীপ্তি বিদ্যাপীঠ গার্লসের ছাত্রী। দিলীপবাবুর স্ত্রী সুপ্রিয়া ঘোষ বলেন, ‘‘কিশোরী মেয়ে জলের মধ্যে জামা তুলে গামছা জড়িয়ে এক পরিচিতের বাড়ি যায়। সেখানে থেকে জামা বদলে স্কুলে যায়। যখন ছোট ছিল তখন এক রকম।’’

এই পানি-পথে প্রতিটি পরিবারই প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন। এক বছর হল আগরপাড়া থেকে পূর্ব বরিশালনগরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন সুজাতা মণ্ডলের স্বামী। সুজাতার কথায়, ‘‘রাস্তা সব সময় জলে ডোবা থাকায় মেয়ে তো বেশির ভাগ দিন স্কুলে, টিউশনে যেতে পারে না। আগে জানলে বাড়ি করতাম না।’’ চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঘরের মেঝেতে পড়ে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হন চায়না দাস। যাতায়াতের সমস্যার কারণেই বেশ কিছু ক্ষণ জখম অবস্থায় পড়েছিলেন ৬৩ বছরের প্রৌঢ়া। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। মস্তিষ্কের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত কল্যাণী হাজারির শরীরে ভারসাম্য নেই। তাঁর ছেলে বিজয় হাজারি বলেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে মাকে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো জরুরি। কিন্তু এমন রোগীকে প্রতিবার জল ঠেলে কী ভাবে নিয়ে যাব!’’

উত্তর দমদম পুরসভার স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর প্রতাপাদিত্য রায় বলেন, ‘‘গত পুরবোর্ড আমার ওয়ার্ডের মধ্যে দিয়ে একটা নর্দমা তৈরি করেছিল। তা দিয়ে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে সংলগ্ন এলাকার নিকাশির জল বেরোয়। সেই নর্দমার সঙ্গে বড় নিকাশি নালার যে সংযোগ তৈরির কথা ছিল তা এখনও হয়নি। যার জেরে জল জমে নৌকা চলার পরিস্থিতি হয়েছে।’’ পুর প্রধান বলেন, ‘‘ভারী বৃষ্টি হলে তবেই ওখানে নৌকা চলে। নিচু জায়গার কারণে কলকাতাতেও তো জল জমে! আমি নিজে সেখানে গিয়ে বাসিন্দারা কী অবস্থার মধ্যে রয়েছেন তা দেখে এসেছি। সমস্যা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেছি। এখন ওই এলাকায় অনেক উন্নতি হয়েছে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস ড্রেনের সঙ্গে সংযোগ হলে সেই সমস্যাও কমবে। জরুরি ভিত্তিতে সেই কাজ হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Water Rain Boat Dumdum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE