Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বোতলের জলে কাচছি বাচ্চার জামা

সাড়ে তিন মাসের বাচ্চাটা নিজের জামা মুখে ঢোকাতে শিখে গিয়েছে। ওর জামা কাচতেও পুরসভার জলে ভরসা করতে পারছি না।

হাসপাতালে আনা হচ্ছে অসুস্থ বৃদ্ধাকে। ছবি :বিশ্বনাথ বণিক।

হাসপাতালে আনা হচ্ছে অসুস্থ বৃদ্ধাকে। ছবি :বিশ্বনাথ বণিক।

নবনীতা গুহ
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:০৬
Share: Save:

সাড়ে তিন মাসের বাচ্চাটা নিজের জামা মুখে ঢোকাতে শিখে গিয়েছে। ওর জামা কাচতেও পুরসভার জলে ভরসা করতে পারছি না। দিনে কয়েক বার ওকে ফোটানো জলে ফর্মুলা মিল্ক গুলে দিতে হয়। সে কাজে তো নয়ই। এমনকী বাচ্চাকে স্নানও করাচ্ছি বোতলবন্দি কেনা জলে। বাড়িতে আমরা মোট চারজন থাকি। সুতরাং জলের খরচটাও মোটেই কম নয়। সব মিলে দিনে কুড়ি লিটারের একটু বেশি কেনা জল লাগছে। এলাকার জলের দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়। জল নিয়ে মারামারিও হচ্ছে।

এত কিছুর পরেও কিন্তু বিপদ ঠেকাতে পারিনি। বাড়িতে চার জনের মধ্যে দু’জনই এখন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। শনিবার রাত সাড়ে তিনটে থেকে বাবার বমি শুরু হয়েছিল।

সঙ্গে পেট খারাপ, গায়ে-মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। ওষুধের পাশাপাশি বাবাকে ওআরএস দেওয়া শুরু করেছিলাম। রবিবার দুপুর থেকে একই উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা-ও। বমি বন্ধ হচ্ছিল না। এমনকী ওআরএস-ও বমি করে ফেলছিলেন। শুনে ডাক্তার বললেন, দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এখন একটি বেসরকারি হাসপাতালে মা ভর্তি। স্যালাইন, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ওষুধ চলছে। দুশ্চিন্তা আর আতঙ্ক সব সময় তাড়া করছে।

আতঙ্কের শুরুটা হয়েছিল শনিবারই। সে দিন বিকেল ৩টে। বাড়ির সামনে হঠাৎই মাইকে ঘোষণা, পুরসভার সরবরাহ করা জল দু’ তিন দিন যেন কেউ না খান।

কেন? জানা গেল, বমি, পেটখারাপের মতো উপসর্গ নিয়ে অনেকেই ভর্তি বাঘাযতীন হাসপাতালে।

শুনেই মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা। তার অন্যতম কারণ, আমার সাড়ে তিন মাসের ছেলে। দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভেবে ফোন করি পাড়ার কাছাকাছি এক দোকানে। সেখানে বোতলের জল পাওয়া যায়। জানতে পারি, পাড়ার প্রায় সবাই তখন জলের জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছেন। রিকশা নিয়ে দু’জনে গেলাম জল আনতে। দেখি, দোকানের সামনে লম্বা লাইন। ২০ লিটারের দু’টি জার কিনে ফিরলাম। বাড়িতে ঢুকতেই মনে পড়ল, কাল রবিবার! কী হবে? সঙ্গে সঙ্গে ওই বিক্রেতাকে ফোনে বলে রাখি, আরও দুটো জার পাঠাতে। আশ্বাস দেন, রাত দশটা বাজলেও জল পৌঁছে যাবে। রাত সাড়ে দশটা। জল আসেনি। ফোন করায় তিনি জানালেন, স্টক শেষ। জল নিয়ে সন্ধ্যায় মারামারি হয়েছে তাঁর দোকানের সামনে। বললাম, পরের দিন সকালে যেন জল অবশ্যই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জল পেলাম বটে, তবে দুপুরে। তা-ও দুটো নয়, একটা জার। যিনি ভ্যানে জল বয়ে এনেছিলেন, তিনি জানালেন, যেন খরা পরিস্থিতি। লোকজন রাস্তাঘাটে দেখলেই বেশি টাকা দিয়েও জল কিনতে চাইছেন। কোনও ক্রমে তাঁদের হাত থেকে জল বাঁচিয়ে জোরে ভ্যান চালিয়ে এসেছেন তিনি।

আমার বাচ্চার দেখাশোনা করেন যিনি, শনিবার সকাল থেকেই বলছিলেন, শরীর ভাল নেই। পেট ভার। তাঁর স্বামীর শরীরও খারাপ। মাইকের ঘোষণা শোনার পর পরই সবটা মিলে একটা ভয় হয়েছিল, তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। রাতেই ফোনে জানালেন, পেটখারাপ আর বমি শুরু হয়েছে। পরের দিন আসতে পারবেন না। সোমবারও আসেননি। মঙ্গলবার কোনও রকমে এসেছেন। বাড়িতে যিনি কাজ করেন, অসুস্থ তাঁর তিন ছেলেমেয়ে।

১০২নম্বর ওয়ার্ডের এখন প্রায় ঘরে ঘরে এই সমস্যা। বাজারে গিয়ে পেঁপে, কাঁচকলা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। বহু কষ্টে এক জায়গায় কাঁচকলা পেলাম। তা-ও অনেক বেশি দামে। সব মিলিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আতঙ্কে কাটছে। নিজে এখনও সুস্থ আছি। কিন্তু কত ক্ষণ থাকব তা জানি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE