Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Thunderstorm

হুইলচেয়ারে বসেই জীবনের খেলায় জেতার পণ

মাঠের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হলেও, ‘নতুন খেলায়’ জেতার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। হুইলচেয়ারে বসেই ফিরছেন জীবনের খেলার দিকে।

দৃঢ়চেতা: হাসপাতালে বসেই ফুটবলে চোখ রনির। নিজস্ব চিত্র

দৃঢ়চেতা: হাসপাতালে বসেই ফুটবলে চোখ রনির। নিজস্ব চিত্র

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮ ০২:৫০
Share: Save:

দল বেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে কাদা মেখে ফুটবল খেলতে ভালবাসত। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে খেলতে গিয়েই ঘটে বিপদ! গলার নীচ থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত সমস্ত সাড় হারিয়ে যায়। তবে, মাঠের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হলেও, ‘নতুন খেলায়’ জেতার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। হুইলচেয়ারে বসেই ফিরছেন জীবনের খেলার দিকে। দিন গুনছেন, ফের ফুটবল পায়ে মাঠে যাওয়ার।

নেতাজিনগরের বাসিন্দা বছর চব্বিশের শম্ভু চৌধুরী ওরফে রনি। ২০১৩ সালে মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলার সময় হঠাৎ মেরুদণ্ডে বিদ্যুৎ প্রবাহ অনুভব করেছিলেন। মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলেন মাঝ-মাঠে। উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। বাবা-মা বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে কোনওরকমে তাঁকে নিয়ে যান বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, বজ্রাঘাতের জেরে আহত হয়েছেন রনি। মেরুদণ্ডের চোট গুরুতর। দ্রুত অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু অস্ত্রোপচার সফল হওয়া সত্ত্বেও থমকে যায় রনির পা! শরীরের অধিকাংশ অসাড় হয়ে থাকে। একমাত্র ছেলে কোথায় গেলে সুস্থ হবে, সন্ধান শুরু করেন রনির বাবা টিঙ্কু চৌধুরী।

২০১৫ সালে তিনি জানতে পারেন, স্নায়ু কিংবা মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের পরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য থেরাপির প্রয়োজন। এর পরে তিনি এসএসকেএম হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে যোগাযোগ করেন। তাঁকে ভর্তি করা হয়। টানা বছর দুয়েক বিছানায় শুয়ে থেকে মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন রনি। দেহের একাধিক জায়গায় ঘা হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা তাঁর হাত-পায়ে সাড় ফিরিয়ে আনার থেরাপির পাশাপাশি শুরু করেন নিউরো-সাইকো থেরাপি।

এসএসকেএম হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, মল-মূত্র ত্যাগ ও নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথম চিকিৎসা শুরু হয়। তার পাশাপাশি চলে নিউরো-সাইকো থেরাপি। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, স্নায়ু ও মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের পরে অধিকাংশ রোগীর কোনও ধরণের রিহ্যাবিলিটেশন হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা ‘স্বাভাবিক’ জীবন ফিরে পান না। তা ছাড়া যাঁরা থেরাপি শুরু করেন, সেটাও হয় অনেক দেরিতে। ফলে, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু শরীরের কোনও একটা অঙ্গ ঠিক মতো কাজ না করলেও যে জীবনে ভাল থাকা যায়, সেই মানসিক শক্তি জোগানোটাই এই থেরাপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এসএসকেএম হাসপাতালের রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিকের তত্ত্বাবধানেই রনির চিকিৎসা হয়। তিনি বলেন, ‘‘রনির বয়স কম। তাই তাঁর মানসিক ভাবে দৃঢ় হওয়া খুব জরুরি ছিল। সেই থেরাপির উপরেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’’

বছর দুয়েকের চিকিৎসার পরে রনি ফিরেছেন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। শরীরের অধিকাংশ অংশেই সাড় ফিরেছে। যদিও পায়ের পাতায় এখনও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সপ্তাহের শেষে বন্ধুদের সঙ্গে দীঘা, মন্দারমণির সমুদ্রে গা ভাসানো থেকে বাবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসা শুরু করা সবই করছেন হুইলচেয়ারে বসে। তবে, হুইলচেয়ার থেকে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাও জারি রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘হুইলচেয়ারে বসে থাকা কোনও অক্ষমতা নয়। ইচ্ছে থাকলে সব কাজ করা যায়, শেষ কয়েক বছরে সেটা বুঝতে পেরেছি। তবে, চেষ্টা চালাব ফের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর।’’

সম্পূর্ণ সেরে ওঠার জন্য এখনও কিছু থেরাপি চালিয়ে যেতে হচ্ছে।তাই মাঝেমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। বিশ্বকাপের মরসুমেও তাই নেমার ভক্ত রনিকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে। তবে, সেই জন্য খেলা বাদ পড়ছে না। কখনও হুইলচেয়ারে বসে আবার কখনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রিয় দলের হলুদ-সবুজ জার্সি পরে মোবাইলেই খেলার স্বাদ নিচ্ছেন রনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE