Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘তা হলে কি নভেম্বর থেকে পুলে জল ছিল’

গত ২০ ফেব্রুয়ারি আলিপুর কম্যান্ড হাসপাতাল চত্বরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের একটি স্কুলে জলে ডুবে মৃত্যু হয় সেখানকারই ছাত্র সম্বুদ্ধ ঘোষের (৪)।

শোকস্তব্ধ: ছেলের স্কুলের সামনে সুচেতনা ঘোষ। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

শোকস্তব্ধ: ছেলের স্কুলের সামনে সুচেতনা ঘোষ। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৯
Share: Save:

২০ ফেব্রুয়ারি। তারিখটা অভিশপ্ত হয়ে রইল সুচেতনা ঘোষের জীবনে। ওই তারিখ, তাঁর নিজের জন্মদিন হওয়া সত্ত্বেও! বরং ৪০তম জন্মদিন নিয়ে কথা বলার সময়ে গলা বুজে আসে তাঁর। মহিলা বলেন, ‘‘আমার জন্মদিনই আমার ছেলের মৃত্যুদিন! দিনটা আর চাই না।’’

গত ২০ ফেব্রুয়ারি আলিপুর কম্যান্ড হাসপাতাল চত্বরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের একটি স্কুলে জলে ডুবে মৃত্যু হয় সেখানকারই ছাত্র সম্বুদ্ধ ঘোষের (৪)। এই ঘটনায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন সম্বুদ্ধের বাবা পেশায় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার কর্মী শুভজিৎ ঘোষ। তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছেন বলেও জানাচ্ছেন। রবিবার সম্বুদ্ধের মা সুচেতনা ফোনে বলেন, ‘‘নিজেকে এখন লোভী মনে হচ্ছে। আমি লোভ করেছিলাম— নিরাপত্তার লোভ, ছেলেকে ভাল ভাবে মানুষ করার লোভ। বহু অভিভাবক নানা অভিযোগ তুলে সন্তানদের ওই স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেও আমি রেখে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এটা সেনা হাসপাতাল চত্বর। এর থেকে নিরাপদ জায়গা আর কী হবে? সেখানেই আমার ছেলের সঙ্গে এমন হবে ভাবিনি।’’

শিশুটির মৃত্যু নিয়ে স্কুলের প্রিন্সিপাল সুদেষ্ণা বসুকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কিছু বলব না। সেনা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন। যা বলার তাঁরাই বলবেন।’’ সেনা সূত্রে জানানো হয়েছে, পুলিশের পাশাপাশি তাঁরাও তদন্ত চালাচ্ছেন। কী ভাবে এমন ঘটল খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

যদিও সুচেতনাদেবী জানাচ্ছেন, তাঁদের লড়াই জারি থাকবে। রবিবারও আলিপুরের সেনা হাসপাতালের বাইরে সুচেতনাদেবীর সঙ্গে মৌন প্রতিবাদে শামিল হন অনেক অভিভাবক। শনিবার স্কুলের তরফে দেখা করে সম্বুদ্ধের ‘প্রেয়ার মিটিং’য়ে থাকতে অনুরোধ করা হয় তার পরিবারকে। সুচেতনাদেবী তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার ক্ষোভ যাচ্ছে না। আমার বাচ্চা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। ও যে হাইপার অ্যাকটিভ, তা জানতেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ? জেনেও কী করে ওকে একা ছেড়ে দিলেন শিক্ষিকা?’’ ঘটনার দিন সম্বুদ্ধের মৃতদেহ উদ্ধার হয় স্কুলের ভিতরের একটি পুল থেকে। ওই পুলে ‘হাইড্রোথেরাপি’ নামে বিশেষ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয় পড়ুয়াদের। সুচেতনাদেবীর প্রশ্ন, ‘‘শীতের সময়ে কোনও পুলেই জল রাখা হয় না। ওই ‘হাইড্রোথেরাপি’র ঘর তালাবন্ধ থাকার কথা। সেখানে সম্বুদ্ধ গেল কী করে? তবে কি ওই ঘরের তালা খোলা ছিল? তা হলে কি নভেম্বর থেকে পুলে জল ছিল?’’

এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই মায়ের চোখে ভেসে উঠছে ছোট্ট সম্বুদ্ধের ছবি। সুচেতনাদেবী একটি স্কুলে পড়ান। দুই সন্তানের মধ্যে সম্বুদ্ধই ছোট। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এখন তার স্কুলে পরীক্ষা চলছে। মেয়েকে পড়াতে পড়াতেই মায়ের মনে পড়ছে, ছেলের স্কুলের টাস্ক করানো, স্কুলের চাকরি— ক’দিন আগেও তাঁর দম ফেলার সময় থাকত না। বলছেন, ‘‘আজ আর সেই ব্যস্ততা কোথায়? ছেলেটাই তো আর নেই!’’

বলতে বলতে মহিলার ফের মনে পড়ে, ২০ ফেব্রুয়ারির কথা। সে দিন স্কুলে মাধ্যমিকের পরীক্ষার‘গার্ড’ দেওয়ার কথা তাঁর। স্কুল থেকে ফিরে রাতে নিজের জন্মদিন উপলক্ষে

ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে বাইরে খেতে যাওয়ার পরিকল্পনা। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে যাওয়ার জন্য ফোন বন্ধ করতে গিয়ে তিনি দেখেন, সম্বুদ্ধ স্কুলের

ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে। স্বামী সেই ছবি পাঠিয়েছেন। ফোন বন্ধ করে খুশি মনে এর পরে

পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে যান সুচেতনা। ১২টা নাগাদ এক সহকর্মী গিয়ে তাঁকে বলেন, তিনি সুচেতনার হয়ে ডিউটি করে দিচ্ছেন। সুচেতনা বরং দ্রুত বাড়ি চলে যান। তাঁর স্বামীর ফোন এসেছিল। এর পরে নিজের মোবাইল ফোন খুলে সুচেতনা দেখেন, প্রচুর ‘মিসড্‌ কল অ্যালার্ট’।

সুচেতনার কথায়, ‘‘তখনও জানি না, আমার জন্মদিনেই ছেলেটা এ ভাবে...!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Children Swimming Pool Army School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE