অকুস্থল: এন আর এসের নার্সিং হস্টেলের সামনে দেখা মিলল কয়েকটি মা-কুকুরের। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
কখনও চেন্নাইয়ের এক মেডিক্যাল কলেজ, কখনও ভেলোর, কখনও আবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। কোনও ক্ষেত্রে কুকুরকে তিনতলার ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, কখনও বাঁদরকে খুন করা হচ্ছে, কখনও আবার পিটিয়ে মারা হচ্ছে ১৬টি কুকুরছানাকে!
আর সব ক্ষেত্রেই নাম জড়াচ্ছে চিকিৎসক-পড়ুয়া বা স্বাস্থ্যকর্মীদের। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ক্রমাগত মৃত্যু, রক্তপাত, অস্ত্রোপচার দেখতে দেখতে কি স্পর্শকাতরতা ভুলে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা? শুধু অন্যেরাই নন, চিকিৎসক মহলের একাংশেও এই প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে। অনেকে আবার চিকিৎসকদের নিয়ে কাউন্সেলিং করানোরও পরামর্শ দিয়েছেন।
পশুপাখিদের মেরে ফেলা বা তাদের উপরে অত্যাচার করা, এমন ১৭টি মামলা নিয়ে আপাতত আদালতের দ্বারস্থ পশুপ্রেমী শ্রাবণ কৃষ্ণন। তিনি জানাচ্ছেন, এর মধ্যে একাধিক ঘটনার সঙ্গে কোনও চিকিৎসক-পড়ুয়া বা স্বাস্থ্যকর্মী জড়িত। শ্রাবণের কথায়, ‘‘কলকাতার এন আর এস হাসপাতালের ঘটনার পরে আর এগুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না। বারবার কেন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা এমন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন, সেটা গুরুত্ব সহকারে দেখা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য পরিষেবায় নিয়োগ করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সেই মানসিক যোগ্যতা আছে কি না, তা দেখা উচিত মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র।’’ আর এক পশুপ্রেমী তিতাস মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমরা নির্দিষ্ট করে এখনই কিছু বলতে চাইছি না। কিন্তু, এন আর এস হাসপাতালে তো গত বছরও এই ঘটনা ঘটেছিল। কেন সব ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও চিকিৎসা চত্বরে ঘটনাগুলি ঘটছে, তা দেখতে হবে।’’
ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এন আর এস হাসপাতালের ঘটনায় এখনই কে জড়িত, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে এটা ঠিক, স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা বর্তমানে যুক্ত তাঁদের প্রতিনিয়ত ভীষণ চাপ ও ভীতির মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। শুধু চিকিৎসকই নন। স্বাস্থ্যকর্মী, প্যারামেডিক্যাল স্টাফ, নার্সেরা আছেন। সেই চাপ বা আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ কার ক্ষেত্রে কী ভাবে হচ্ছে, সেটা বলা খুব মুশকিল। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘পুরো চিকিৎসক-মহলের সঙ্গেই রাজ্য সরকারের আলাদা করে কথা বলা উচিত। একটা কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন।’’
ইএনটি সার্জন দুলালচন্দ্র বসু বলেন, ‘‘চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য পরিষেবায় কাজ করতে গেলে আলাদা মানসিকতা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে শুধু টাকা উপার্জনটাই মুখ্য হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেও অনেক ঘটনা ঘটছে।’’ যদিও চিকিৎসক স্বপন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘এটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সঙ্গে নির্দিষ্ট কোনও পেশার যোগ নেই। এটা অপরাধী মানসিকতা। না হলে কেউ এ ভাবে পিটিয়ে ১৬টি কুকুরছানাকে মেরে ফেলতে পারে?’’
মনোবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, ডাক্তার হতে গেলে একটা সীমা পর্যন্ত স্পর্শকাতর মানসিকতাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। তা না হলে অন্যের চিকিৎসা করা যায় না। কিন্তু এন আর এস হাসপাতালের ঘটনার উপরে তার কোনও প্রভাব রয়েছে বলে মনে করছেন না তাঁরা। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলছেন, ‘‘এটা পুরোপুরি নৃশংসতা। নিজেদের মধ্যে এই নৃশংস ভাবটা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিরক্তি ও আক্রোশ। সব কিছুর বহিঃপ্রকাশ হয়েছে কুকুরছানাদের পিটিয়ে মারায়। এই ধরনের মানসিকতা যাঁদের, তাঁরা শুধু কুকুরছানাই নয়, নিজেদের বাচ্চা বেশিক্ষণ কান্নাকাটি করলে তাকেও যে ভাবে মারতে পারেন সেটা সাধারণ মানসিকতার মানুষে পারবেন না।’’ সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডুর মতে, ‘‘এটা আসলে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, যা বিকৃতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই নিজের থেকে কম শক্তিশালী প্রাণীকে মেরে একটা আলাদা উন্মাদনার বোধ তৈরি হচ্ছে। সামাজিক ভাবে আমরা হিংস্র হয়ে উঠছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy