Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বরো-৪

লোকসভার হাওয়া পুরভোটেও বইবে কি না, সেটাই প্রশ্ন

চার নম্বর বরোর দশটি ওয়ার্ডের সাতটিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে। এ বার তারা কি ধরে রাখতে পারবে জয়ের সেই ধারা? বড়বাজার থেকে রাজাবাজার জুড়ে বিস্তৃত ওই অঞ্চলে পুর-নির্বাচন ঘিরে সেই জল্পনাই তুঙ্গে। লোকসভা ভোটের ওই অঙ্কে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে তৃণমূল।

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

চার নম্বর বরোর দশটি ওয়ার্ডের সাতটিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে। এ বার তারা কি ধরে রাখতে পারবে জয়ের সেই ধারা?

বড়বাজার থেকে রাজাবাজার জুড়ে বিস্তৃত ওই অঞ্চলে পুর-নির্বাচন ঘিরে সেই জল্পনাই তুঙ্গে। লোকসভা ভোটের ওই অঙ্কে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে তৃণমূল। অবাঙালি ভোটরদের কাছে টেনে বুঝতে চেয়েছেন তাঁদের চাহিদা। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, উন্নয়ন হয়েছে নামমাত্র। উল্টে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে তৃণমূলের অন্দরের অসন্তোষে জয়ের ব্যবধান আরও বাড়বে। তৃণমূলের বক্তব্য, লোকসভা আর পুরভোট এক নয়। পাঁচ বছরে পুরসভার উন্নয়নের জোয়ার প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করে দেবে।

গত পুরভোটে এই বরোর ২২ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড বিজেপি দখল করে। বামেদের ছিল ২১ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড। বাকি ৬টি ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮ ও ৩৮ তৃণমূলের। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা বোরো চেয়ারম্যান স্মিতা বক্সির দাবি, “এ বার আমরা বড়বাজারের বিজেপির দুটো ওয়ার্ডই দখল করব।” দাবি উড়িয়ে বিজেপির ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র মীনাদেবী পুরোহিতের দাবি “বড়বাজারের দু’টি ওয়ার্ড তো জিতছিই, বাকি আটটির মধ্যে আরও কয়েকটি ওয়ার্ডে জিতব।”

এত আত্মবিশ্বাসের কারণ? মীনাদেবীর জবাব, “পুর-পরিষেবার বেহাল দশা ও তৃণমূলের প্রার্থীদের মধ্যে টিকিট নিয়ে ক্ষোভ ওই বরোয় বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড জিততে সাহায্য করবে।”

৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাম কাউন্সিলর মহম্মদ জসিমুদ্দিন দল বদলে তৃণমূলে। দলে যোগ দিয়েই তাঁর টিকিট পাওয়া পছন্দ নয় এলাকার তৃণমূলকর্মীদের। দীর্ঘ দিনের কর্মী আলি হোসেন ওরফে সোনু ভাই টিকিট না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তৃণমূলের একাংশ ভোটের প্রচারে নেই। প্রচারে ওই কোন্দলের কথা বলে বেড়াচ্ছে বিজেপি। যদিও জসিমুদ্দিন জানান, “সোনু ভাইকে নিয়েই ওয়ার্ডে প্রচার চালাচ্ছি।” তাঁর দাবি, “বিজেপির প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে তো ওদের রাজ্য দফতরেই মারামারি চলছে। ওরা বরং সে দিকেই মন দিন।”

বড়বাজারের পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট, রবীন্দ্র কানন ও নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের একাংশ নিয়ে ২৪ নম্বর ওয়ার্ড। গত উপ-নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে জিতে কাউন্সিলর হয়েছিলেন মৃণাল সাহা। তাঁর বাবা মিহিরকুমার সাহার মৃত্যুতে সেখানে উপ-নির্বাচন হয়। এ বার সেটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। সেখানে তৃণমূল প্রার্থী, মৃণালবাবুর স্ত্রী ইলোরা সাহার সঙ্গে লড়াই জমে উঠেছে বিজেপি-র পূর্ণিমা কোঠারীর। লড়াইয়ে আছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের সরিকা সাউ ও কংগ্রেসের দীপালি চৌধুরীও। গত লোকসভা ভোটে এখানে জেতে বিজেপি। পূর্ণিমাদেবীর কথায়, “এই ওয়ার্ডে তৃণমূল পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি করছে।” পূর্ণিমাদেবীর অভিযোগ উড়িয়ে ইলোরাদেবী বলেন, “এলাকায় কী কাজ হয়েছে, মানুষ জানেন। ভোটবাক্সে তাঁরা জবাব দেবেন। বিজেপি মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।”

২৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজার জায়গায় এ বার দাঁড়াচ্ছেন পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের অফিসার রবীন চট্টোপাধ্যায়। এলাকাবাসীর কাছে খবর ছিল, ওই ওয়ার্ডে মেয়েকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন শশী পাঁজা। কিন্তু হয়নি। আর তৃণমূূলের বিরুদ্ধে প্রচারে সেটাই হাতিয়ার করতে চাইছেন বিজেপির যশোবন্ত সিংহ। তাঁর বক্তব্য, “২৬ নম্বরে ওদের কে দাঁড়াবে তা নিয়েই তৃণমূলের মধ্যে মত বিরোধ ছিল।” অন্য দিকে ওই ওয়ার্ডে সাধন পাণ্ডের ঘনিষ্ট শঙ্কর সরকারকে দাঁড় করানোর ব্যাপারেও তৃণমূলের অন্য একটা অংশ সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু শঙ্করবাবু শেষ পর্যন্ত টিকিট না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তৃণমূলেরই এক দল ভোটের প্রচারে বেরোচ্ছেন না।” তবে ‘উড়ো’ খবরে আমল দিতে চান না শশীদেবী। বললেন, “ভোটে এ সব চলে। অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা। তৃণমূলের সবাই একযোগে প্রচার চালাচ্ছে। আর পড়াশোনায় ক্ষতি হবে বলে আমি মেয়েকে দাঁড়াতে দিইনি। যোগ্য প্রার্থী রবীন চট্টোপাধ্যায় দাঁড়িয়েছেন।”

বিবেকানন্দ রোড, মানিকতলা, চালতাবাগান এলাকা নিয়ে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় তৃণমূূলের প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর রাজকিশোর গুপ্তর পুত্রবধূ মীনাক্ষী গুপ্ত। রাজনীতিতে আনকোরা মীনাক্ষীদেবীর টিকিট নিয়ে তৃণমূলেরই একাংশের ক্ষোভ রয়েছে। তা কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লেগেছে কংগ্রেস ও বিজেপি। হাতচিহ্নে লড়ছেন উত্তর কলকাতার কংগ্রেস নেতা রাণা রায়চৌধুরীর স্ত্রী তপতী রায়চৌধুরী। বিজেপি প্রার্থী মঞ্জু জায়সবালের অভিযোগ, “গত ৫ বছরে বেআইনি নির্মাণে মদত দিয়েছে তৃণমূল। এলাকার মানুষ সবই জানে।” যদিও রাজকিশোর গুপ্তর পরিবারের দাবি, প্রচারে গিয়ে অন্তত তারা এরকম কিছু টের পাচ্ছেন না।

ক্ষোভ রয়েছে ৩৮ নম্বরেও। গত বার ওই ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হলেও এ বার সাধারণ আসন। দল ফের কাউন্সিলর সাধনা বসুকে প্রার্থী করায় ক্ষুব্ধ তৃণমূলের এক ছাত্রনেতার ঘনিষ্ঠেরা। এত অসন্তোষ ছিল যে রাজাবাজার মোড়ে তৃণমূল কর্মীরাই সাধনা বসুর টিকিট পাওয়ার বিরুদ্ধে তিন দিন অনশন করেন। তৃণণূলকে অস্বস্তিতে ফেলতে প্রচারে সে কথা বলে বেড়াচ্ছেন কংগ্রেস প্রার্থী দেবাশিস পাইন। তিনি বলেন, ‘‘সকাল বিকেল বিজেপি প্রার্থী পাল্টেছে। এ নিয়ে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে।” প্রচারে তাও ফলাও করে বলছে কংগ্রেস। তবে তৃণমূলের সাধনা বসু বলেন, “এখানে তৃণমূল ছিল, থাকবেও।” লোকসভা ভোটে এই ওয়ার্ডে এগিয়ে থাকায় বিজেপিও টগবগে। লড়ছেন বাম প্রার্থী তপন চক্রবর্তীও। বিজেপি প্রার্থী মহম্মদ সামসাদের কথায়, “অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছি।’’ তবে এগিয়ে তৃণমূলই।

রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট হয়ে রাজাবাজার পর্যন্ত ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে সিপিএম ময়দানে নামিয়েছে নতুন মুখ সৌমিত্র চক্রবর্তীকে। পদ্মফুল-চিহ্নে লড়ছেন শাহ আলম এবং হাত চিহ্নে শাহিনা জাভেদ। গত পুর-নির্বাচনে এখানে তৃণমূলের প্রতীকে লড়ে জেতেন ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলম। এ বার সরে গিয়েছেন ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ডেপুটি মেয়রের ওয়ার্ড হওয়ায় এলাকায় কিছু কাজ হয়েছে, মানছেন বাসিন্দাদের একাংশই।

২২ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলর মীনাদেবী পুরোহিতকে টেক্কা দিতে তৃণমূল এ বার প্রার্থী করছে প্রাক্তন বিধায়ক দীনেশ বাজাজকে। তাতেই জমে উঠেছে ওই ওয়ার্ডের লড়াই। সরাসরি পুর-পরিষেবার ঘাটতির কথা না বলে দীনেশ বলছেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বচ্ছ ভারত অভিযানকেই মানছে না বিজেপি কাউন্সিলরেরা। বড়বাজার এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় ভ্যাট উপচে উঠছে। কোনও কম্প্যাক্টর নেই।”

বড়বাজারের মূল সমস্যা বেআইনি পার্কিং ও হকার। এই দুই সমস্যার সমাধান কী ভাবে হবে তা নিয়ে অবশ্য কোনও দিশা দেখাতে পারেননি বর্তমান কাউন্সিলর মীনাদেবী পুরোহিত। তিনি শুধু বলেন, “এই নিয়ে পুর-অধিবেশনে অনেক বার লিখিত ভাবে জানিয়েছি। কিন্তু বর্তমান পুরবোর্ড কোনও উদ্যোগই দেখায়নি।” তবে পানীয় জল ও জল জমার সমস্যা থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়েছে বড়বাজার। দাবি মীনাদেবীর। পাশেই ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর বিজয় ওঝা অবশ্য বলেন, “পার্কিং সমস্যার সমাধান হয়নি ঠিকই কিন্তু আমার ওয়ার্ডের অধিকাংশ সরু রাস্তাকেই কংক্রিট করেছি।”

পোস্তা এবং নিমতলা স্ট্রিটের কিছুটা এলাকা নিয়ে ২১ নম্বর ওয়ার্ড। সিপিএম কাউন্সিলর অজয়কুমার সাহা এ বারও প্রার্থী। তাঁর দাবি, “সিপিএম এর কাউন্সিলর বলে কী আমার দিকের গঙ্গার ঘাটগুলোর কোনও উন্নতি হবে না? বড় বড় ইঁদুর বড়বাজারের রাস্তা খুড়ে গর্ত করে দিয়ে ধস নামিয়ে দিচ্ছে। গোডাউনের দেওয়াল বড় বড় গর্ত করে ফেলছে।” এখানে তৃণমূলের প্রার্থী তারাদেবী পুরোহিত। বামেদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে মরিয়া তারাদেবী। বাম কাউন্সিলরের তোলা অভিযোগ মানতে নারাজ ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান স্মিতা বক্সি। তাঁর বক্তব্য, “অধিকাংশ রাস্তাই কংক্রিট হয়ে গিয়েছে। ওয়ার্ডে কম্প্যাক্টর বসানো হয়েছে। ফলে ইঁদুরের উপদ্রব কমেছে।”

যদিও ওই ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী সুনীল হর্ষের মতে, “২৫ নম্বর ওয়ার্ডে গত পাঁচ বছরে গরিব মানুষদের জন্য একটা কমিউনিটি হল পর্যন্ত তৈরি হয় নি। স্মিতাদেবীর আমলে শুধু লাভবান হয়েছেন প্রোমোটাররা। সরু রাস্তায় বহুতল হয়েছে। মানুষের সমস্যা বেড়েছে।” তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে স্মিতা বক্সি বলেন, “৩০ বছর ধরে আমি মানুষের সঙ্গে আছি। কী ভাবে মানুষের সমস্যা মেটাতে হয় তা আমাকে বিজেপি প্রার্থীর কাছে শিখতে হবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE