Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Capgras Syndrome

বিস্মরণের বর্ম ছিঁড়ে নতুন আরম্ভ দম্পতির

অফিসের কাজে মোটে দেড় সপ্তাহের জন্য বাড়ি ছিলেন না স্বামী। যখন ফিরলেন, সে এক অন্য বাড়ি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:০৫
Share: Save:

বহু বছর এক সঙ্গে পথ চলা দম্পতি পুরনো হিন্দি ছবির গানের সুর শুনে উদ্বেল হয়েছেন, এমনটা হয়েছে বই কী! ‘চলো এক বার ফিরসে আজনবী বন জায়ে হাম দোনো...’।

কিংবা বুকের মধ্যে উথলে উঠেছে রবীন্দ্রগান! যদি তারে নাই চিনি গো সে কী...! এ সব গানটান আক্ষরিক ভাবে সত্যি হয়ে জীবনে ঢুকে পড়লে কিন্তু মুশকিল। আমেরিকায় প্রবাসী, এ শহরে শিকড় এক দম্পতির জীবনেই সদ্য দেখা দিয়েছিল, এমনই চিত্রনাট্য সুলভ অভিঘাত।

অফিসের কাজে মোটে দেড় সপ্তাহের জন্য বাড়ি ছিলেন না স্বামী। যখন ফিরলেন, সে এক অন্য বাড়ি। স্ত্রী বলছেন, ‘‘কে আপনি? আপনাকে তো চিনি না...!’’ দম্পতির ১৭ বছরের ছেলে বলছে, ‘‘মা, তুমি বাবাকে চিনতে পারছ না!’’ তার মা বলছেন, ‘‘তোর বাবার মতো দেখতে লোকটা! কিন্তু বাবা নয়!’’ বহু বছরের ঘরগেরস্থালি যাপন করা স্বামীকে স্ত্রী সটান বলছেন, ‘‘শুনুন, আমি আপনাকে চিনি না। এখান থেকে চলে যান। কেন ছদ্মবেশের ভেক ধরছেন! অন্য লোকের সঙ্গে আমি কিছুতেই এক ঘরে থাকব না।’’

চেনা মানুষকে বিস্মরণের কিংবা ‘আমি কে’ তা ভুলে যাওয়ার কাহিনি নিয়ে বলিউড-টলিউডেও হিট ছবির ছড়াছড়ি! আবার ধ্রুপদী সাহিত্যে কালীদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমের কাহিনি কে না জানে! এ যাত্রা, পোড়খাওয়া মাঝবয়সি বর বাবাজির দশা কন্ব মুনির আশ্রম থেকে পতিগৃহে হাজির তরুণী শকুন্তলার মতো। রাজা দুষ্মন্ত কিন্তু তাঁকে চিনতে পারছিলেন না। শকুন্তলার মতোই জীবনে কাঙ্ক্ষিত সুখ বা প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার পাসওয়ার্ড ‘হারিয়ে ফেলা আংটির’ জন্য মাঝবয়সি বঙ্গসন্তান তখন অস্থির হয়ে উঠেছেন। তবে ধৈর্য হারাননি।

ঘরময় ছড়ানো দু’জনের সাংসারিক জীবনের নানা চিহ্ন, ছবির অ্যালবাম। সে সব দেখিয়ে বোঝাতে গেলে স্ত্রী আরও রেগে ওঠেন। অগত্যা বৌকে শান্ত রাখতে ভদ্রলোক বাড়ি ছেড়ে হোটেলে থাকতে শুরু করলেন। সন্তর্পণে স্ত্রীর চিকিৎসার চেষ্টাও শুরু করেন। কিন্তু লাভ হচ্ছিল না। উল্টে রোগিণীর স্মৃতি আরও ঝাপসা হচ্ছিল। তাঁর বাবা-মা সব শুনে আমেরিকায় এলেন। রোগিণী কিছু দিন বাদে বলতে শুরু করেন, আমার বাবা তো মারা গিয়েছেন! ইনি আমার বাবা নন!

রোগিণীর স্বামী ক্রমশ বুঝতে পারেন, স্ত্রীকে সারিয়ে তুলতে কলকাতায় পরিচিত পরিবেশ, স্মৃতি-জড়িত পরিসরে নিয়ে যেতে হবে। তার পরে শেষ চেষ্টা...।

গত জুলাইয়ে ওঁরা দেশে ফেরেন। এসএসকেএম হাসপাতালের মনোরোগের চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয় ওই পরিবারটি। ডাক্তারবাবুদের মতে, এ হল ‘ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম’। এক ধরনের মানসিক বিভ্রমে ঘনিষ্ঠতম পরিজনটিকেও অচেনা মনে হয়। পরিচিত কারও ভেক ধরা ছদ্মবেশী। স্বামী, স্ত্রী, মা, বাবার মতো কাছের সম্পর্কেও এমন ঘটতে পারে। এসএসকেএমের ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘আমার দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে মাত্র দু’টি এ ধরনের কেস দেখেছি।’’

কলকাতায় ফেরার পরে অসুস্থ মহিলাকে সারিয়ে তুলতে কিন্তু জোট বাঁধে গোটা পরিবার। একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওঁরা থাকতে শুরু করেন। তবে স্বামী বা ছেলে অন্যত্র থাকতেন। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘মহিলাকে সারিয়ে তোলার স্বার্থেই ওঁর স্বামী, ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছিল।’’ রোগিণীর মা, বাবা, ভাসুর, জা মিলে তাঁর শুশ্রূষার চেষ্টায় শরিক হন। চিকিৎসকেরা নানা ভাবে স্মৃতি ফেরানোর প্রক্রিয়া চালু করেন। স্কুল, কলেজ, পুরনো দিনের কথা আলোচনা করতেন তাঁরা। ডাক্তারির পরিভাষায়, যা ‘ইনসাইট ওরিয়েন্টেড সাইকোথেরাপি’ বলা হয়।

রোগিণীর স্বামীকে চিনতে পারার জট খোলাই ছিল ডাক্তারদের আসল কাজ। মহিলা তখনও বলে চলেছেন, ‘‘কলকাতায় আমার সঙ্গে যে এসেছে, ও আমার বর নয়!’’ এই পরিস্থিতিতে ভদ্রলোককে আমেরিকায় ফিরে সেখান থেকে স্ত্রীকে ফোন করতে বলেন ডাক্তারেরা। সেটাই এ ক্ষেত্রে মোক্ষম ওষুধের কাজ করে। প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘মাসখানেক পরে রোগিণী নিজেই স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চান।’’ এ বার দু’জনের দেখা হতে মহিলা কিন্তু স্বামীকে চিনতে পারলেন।

টানাপড়েন শুরু হয়েছিল ২০১৮-র অক্টোবরে। এত দিনে মুশকিল আসান। রোগিণীর স্বামীর ধৈর্য এবং গোটা পরিবারটির সহযোগিতার অকুণ্ঠ প্রশংসা করছেন ডাক্তারবাবুরা। আর এত দিন বাদে হারিয়ে পাওয়ার পরে স্বামী বলছেন, ‘‘মনের অসুখে ধৈর্য দরকার। আর ভালবাসলে প্রিয়জনের সেরে ওঠার জন্য অপেক্ষাটুকু নিশ্চয়ই সম্ভব!’’

বিস্মরণের বর্ম ভেদ করে সত্যিই নতুন করে জীবন শুরু হচ্ছে দু’জনের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Capgras Syndrome SSKM Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE