Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

অন্ধকূপে বন্ধ মেট্রো, পোড়া গন্ধ

তৈরির সময়েই বিদেশি প্রযুক্তিবিদেরা সতর্ক করেছিলেন, এই এক কিলোমিটার পথে কখনওই যেন মেট্রো থমকে না যায়! সেখানে সুড়ঙ্গের মধ্যে স্বাভাবিক হাওয়া ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি তাঁরা। সুড়ঙ্গের আকৃতিও অন্য জায়গার থেকে আলাদা। ডিমের মতো। কারণ, সুড়ঙ্গের ওই জায়গার উপর দিয়েই বইছে বেলগাছিয়া খাল।

আটকে মেট্রো। সুড়ঙ্গে ত্রস্ত যাত্রীরা। শনিবার রাতে। ছবি: তপন মজুমদার।

আটকে মেট্রো। সুড়ঙ্গে ত্রস্ত যাত্রীরা। শনিবার রাতে। ছবি: তপন মজুমদার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৬
Share: Save:

তৈরির সময়েই বিদেশি প্রযুক্তিবিদেরা সতর্ক করেছিলেন, এই এক কিলোমিটার পথে কখনওই যেন মেট্রো থমকে না যায়! সেখানে সুড়ঙ্গের মধ্যে স্বাভাবিক হাওয়া ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি তাঁরা। সুড়ঙ্গের আকৃতিও অন্য জায়গার থেকে আলাদা। ডিমের মতো। কারণ, সুড়ঙ্গের ওই জায়গার উপর দিয়েই বইছে বেলগাছিয়া খাল।

শনিবার সন্ধ্যায় সেই ‘ডেঞ্জার জোন’-এই থমকে গেল মেট্রো। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, যান্ত্রিক ত্রুটিতেই এই বিপত্তি। এর জেরে প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের। অনেকেই অল্পবিস্তর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই মহিলাকে আর জি করে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বড় বিপদের খবর মেলেনি। মেট্রোকর্তারা অনেকেই বলছেন, “কপালজোরে মেট্রোর ইতিহাসে সব থেকে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেলেন যাত্রীরা।” মেট্রোর তরফে দাবি, উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে কয়েক জন চিকিৎসককেও ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল।

শহরে মেট্রো বিপত্তি নতুন কিছু নয়। গত বছর জুনেও ময়দান ও পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের মাঝে সুড়ঙ্গে আটকে যায় একটি মেট্রো। সে বারেও উদ্ধারে দেড় ঘণ্টা সময় নিয়েছিল মেট্রো। কিন্তু এমন ভয়াবহ জায়গায় থমকে যাওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি বললেই চলে।

কী হয়েছিল এ দিন? মেট্রো সূত্রের খবর, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ দমদম থেকে একটি এসি মেট্রো কবি সুভাষের উদ্দেশে রওনা দেয়। বেলগাছিয়া ছাড়ার পরেই ট্রেনটি আটকে যায়। থার্ড লাইনে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। কিন্তু ট্রেনটি বিদ্যুৎ টানতে পারছিল না। প্রযুক্তির ভাষায়, একে ‘লো মোটোরিং’ বলে। যাত্রীদের একাংশ জানান, ট্রেন আটকানোর পরেই বেশির ভাগ কামরা অন্ধকার হয়ে যায়। থমকে যায় হাওয়া চলাচল। মিনিট দশেক পরে পিছনের কয়েকটি কামরার আলোও নিভে যায়। আঁধার টানেলে আতঙ্কে অনেকেই চিৎকার জুড়ে দেন। বহু যাত্রী প্রাণপণ চেষ্টায় ভেঙে ফেলেন অনেকগুলি কাচ। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে কয়েক জন মেট্রোকর্মীকে দেখা যায়। খোলে দরজাও। শুরু হয় উদ্ধারকাজ। সেই কাজ শেষ হতে আরও ৪৫ মিনিট গড়িয়ে যায় বলে মেট্রো সূত্রের খবর।

মেট্রোর একটি সূত্র বলছে, প্রথমে থার্ড লাইনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তার পরে উদ্ধার শুরু হয়। যাত্রীদের সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে হাঁটিয়ে বের করা হয়। সাড়ে ন’টা নাগাদ শ্যামবাজার স্টেশনের বাইরে দেখা যায়, বহু যাত্রী তখনও বেরিয়ে আসছেন। চোখেমুখে আতঙ্ক। “বেশির ভাগ যাত্রীকেই শ্যামবাজার দিয়ে বার করা হয়েছে। জনা পঞ্চাশ বেলগাছিয়া দিয়ে বেরিয়েছেন,” বলেন এক মেট্রোকর্তা।

এ দিনের ঘটনায় ফের প্রশ্ন উঠেছে মেট্রোর বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা নিয়ে। এমন বিপজ্জনক জায়গায় আটকানোর পরে উদ্ধারে এত সময় লাগল কেন, প্রশ্ন অনেকের। এক নিত্যযাত্রীর মন্তব্য, “শহরের গৌরব বলে বিজ্ঞাপন করেন মেট্রোকর্তারা। সেই গৌরবের নিরাপত্তা ও বিপর্যয় মোকাবিলার এমন হাল কেন!”

মেট্রো সূত্রেও এই গাফিলতির কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। মেট্রোকর্তাদের একাংশ বলছেন, সুড়ঙ্গে কয়েকশো মিটার অন্তর স্বাভাবিক হাওয়া ঢোকানোর ব্যবস্থা থাকে। রাখা হয় স্বাভাবিক ফাঁকও। কিন্তু খালের নীচ দিয়ে যাওয়ায় এখানে ফাঁক রাখা হয়নি। বেলগাছিয়া ও শ্যামবাজার থেকে পাইপে হাওয়া টেনে এনে ছাড়া হয়। কিন্তু অনেকে থাকলে সেই হাওয়া যথেষ্ট নয়। “ওই এলাকায় তাই ট্রেনের গতিও বেশি রাখা হয়,” বলছেন এক মেট্রোকর্তা।

মেট্রো সূত্রের খবর, প্রযুক্তিগত কারণেই ওই এলাকায় সুড়ঙ্গের আকৃতি ডিম্বাকৃতি। খালের নীচে হওয়ায় বেলগাছিয়া ছাড়ার পরেই সুড়ঙ্গ ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ফের উঠেছে। লাইনের পাশে হাঁটার জায়গা প্রায় নেই। অর্থাৎ, জায়গাটি নৌকোর মতো! দু’দিকে উঁচু, মধ্যে ঢালু। মেট্রোর এক কর্তার কথায়, “এমন আকারের সুড়ঙ্গের জন্য যাত্রীদের হেঁটে বেরিয়ে আসাও কষ্টকর।”

শুধু ভোগান্তিই নয়, ভিড়ে খোওয়া গিয়েছে বহু যাত্রীর মোবাইল, মানিব্যাগও। শ্যামবাজার স্টেশনে কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও করেন কয়েক জন যাত্রী। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ শ্যামবাজারে দুই মহিলা যাত্রীকে ঢুকতে দেখে আটকান কর্মীরা। মহিলারা জানান, তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন জিনিস খোওয়া গিয়েছে। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে চান তাঁরা। কিন্তু প্রথমে কর্মীরা রাজি হননি। পরে এক অফিসারের হস্তক্ষেপে মহিলারা ভিতরে ঢোকেন। সংবাদমাধ্যমকে এড়াতে দুই মহিলাকে অন্য গেট দিয়েও বের করেন ওই কর্মীরা।

সন্ধ্যায় মেট্রোর বিভ্রাটে নাকাল হয়েছে রাজপথও। ঘটনার পরেই দু’দিকেরই মেট্রো চলাচল বন্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৪৫ মিনিট পরে ৮টা ১৫ মিনিট নাগাদ সেন্ট্রাল থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত আপ ও ডাউনে মেট্রো চালানো হয়। উত্তম চক্রবর্তী, নামে এক যুবক রাত আটটা নাগাদ চাঁদনি চক স্টেশনে ঢোকেন। সেখানেই ঘোষণা শুনেই বেরিয়ে আসেন উত্তম ও তাঁর সহযাত্রীরা। উত্তমের কথায়, “বাস-ট্যাক্সি পেতেও লোকে হয়রান হয়েছে। তবে শনিবার বলে কিছুটা ভিড় কম ছিল। না হলে মাটির উপরেও পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারত।” ভিড় নজরে এসেছে শ্যামবাজার, ধর্মতলা, এক্সাইড মোড়-সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। যাত্রীদের অভিযোগ, সুযোগ বুঝে বেশি ভাড়া হেঁকেছে ট্যাক্সি। মেট্রো জানিয়েছে, রাত ১০টা ৫মিনিটে ফের স্বাভাবিক ভাবে মেট্রো চলাচল শুরু হয়। কিন্তু আতঙ্কে অনেকেই তখন সে পথ মাড়াননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

metro technical snag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE