এটাই রক্ষে, সময়টা শনিবারের সন্ধ্যা। অফিস ফেরত ভিড়ের ঠাসাঠাসি তাই কিছুটা কম। কামরার ভিড়ে অন্তত হেঁটে-চলে বেড়ানোর মতো জায়গা ছিল। না হলে দম আটকেই প্রাণটা বেরিয়ে যেত! তিন বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এক মহিলা হাপুস কেঁদে চলেছেন। ধোঁয়ার অসহ্য গন্ধে নাকে রুমাল চেপে ভাবছিলাম, আমার ছ’বছরের মেয়েটার কথা।
বেলগাছিয়া থেকে শ্যামবাজারের মাঝে সুড়ঙ্গ যে আসলে কলকাতার আদ্যিকালের পচা খালের নীচে, তখন খেয়াল ছিল না। পরে শুনেছি, পাতালরেলের গোটা সুড়ঙ্গে ওই অংশটাই সব থেকে বিপজ্জনক। দম বন্ধ হয়ে আসার কারণটা এখন ঠিকঠাক বুঝতে পারছি। তবে তখন ও সব মাথায় ঢুকলে বোধহয় চিন্তায়-আতঙ্কে হার্টফেল করতাম।
বারাসতে অফিস সেরে রোজই তো বাড়ি ফিরি মেট্রোয় চেপে। কবি নজরুল স্টেশনে গিয়ে নামি। শ্যামবাজারের দিকে যেতে যেতে ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেলেও তখন ভাবিনি, অত ক্ষণের জন্য আটকে যেতে হবে। তখন সাড়ে সাতটা মতো বেজেছে। এসি কোচ ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল। একেবারের পিছনের দিকের ক’টা কামরায় গোড়ায় আলো জ্বলছিল, কিছু ক্ষণের মধ্যে তা-ও নিভে যায়। নিঃশ্বাসের কষ্টটাও তখন থেকেই তীব্র হয়ে উঠছে। সঙ্গে বুক ছ্যাঁত করে ওঠা, এক ধরনের পোড়া গন্ধ।
কী করব, বুঝতে পারছিলাম না! সিট থেকে উঠে আমরা ক’জন হেঁটে কয়েকটা কামরা এগিয়ে গেলাম। দেখছি, ধোঁয়ার গন্ধটা আরও কষ্ট দিচ্ছে। তখন আবার আগের জায়গায় ফিরে আসা। নিজেকে মনে-মনে বলতে শুরু করি, এতটা ভয় পেলে চলবে না। মনটা শক্ত না করলে শরীর আরও অসুস্থ লাগতে শুরু করবে। ট্রেনের চালককেও তখন দেখছি, কামরায় ঢুকে ঘোরাঘুরি করছেন। ফোনে কথা বলছেন। আমাদের মোবাইলে তো টাওয়ার নেই। রাতে বৌ, মেয়েকে নিয়ে একটা নেমন্তন্নে যাওয়ার ছিল। সময় যত গড়াচ্ছে ভাবছিলাম, ওরা তো ভয় পেয়ে ফোন করতে শুরু করবে!
১৫ মিনিট, ২০ মিনিট, আধ ঘণ্টা...সময়টাকে ক্রমশ কয়েক ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। কেউ কেউ অধৈর্য হয়ে ট্রেনের চালকের উপরে চোটপাট শুরু করছিলেন। কয়েক জন দেখলাম, ওঁদের শান্ত হতে বললেন। চালকই বা কী করবেন! ওঁর কী দোষ!
কিন্তু কোনও সাহায্যই তো আসছে না। অন্তত দরজাটা যদি খোলা থাকত। একটু বাতাসের জন্য হাহাকারে কেউ কেউ কামরার গায়ে দমাদ্দাম ঘা দিতে শুরু করেছেন। এক বৃদ্ধকে তাঁর স্ত্রী বলছিলেন, ‘তুমি একটু ঠান্ডা হয়ে ব’সো! নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে।’
এমন বিপদেও হাসি পেয়ে গেল, যখন দেখলাম চালক যাত্রীদের কাছে জনে-জনে স্ক্রু ড্রাইভারের খোঁজ করছেন। ওঁরাই তো নিষেধ করেন, ও-সব নিয়ে মেট্রোয় উঠতে। বিপদের কথা ভেবে নিজেরা কোনও ব্যবস্থাই রাখেননি! আমাদের কামরার একটি ছেলের ব্যাগ থেকে কী একটা নিয়েই চালক কিছু ক্ষণ খুটখুট করলেন।
অবশেষে দরজা খুলল, রাত সওয়া আটটা নাগাদ। সুড়ঙ্গের কিনারে পাশাপাশি দু’জন হাঁটারও জায়গা নেই। পা টিপে-টিপে এগোতে এগোতে সেটাই স্বর্গ মনে হচ্ছিল। পাঁচ-সাত মিনিট হবে, শ্যামবাজারের প্ল্যাটফর্মের আলো চেখে পড়ল। হা-ক্লান্ত দশায় প্ল্যাটফর্মে পা রেখেই স্ত্রীকে ফোনটা করলাম। তার পরে লাইন ঠেলে উপরে উঠে, বাসই ভরসা।
অন্ধকূপের থেকে কলকাতার রাস্তার যানজট ঢের ভাল। জানি না, কাল সাহস করে ফের সুড়ঙ্গ-পথে নামতে পারব কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy