Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
রিপোর্টে জানাল সিএজি

বিদ্যুৎ-চুক্তি ভেঙে পুরসভা গুনাগার দিচ্ছে ১৫ কোটি

একেই ভাঁড়ে মা ভবানী। তার উপরে নিজেদের ভুলের মাসুল হিসেবে বাড়তি ১৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে কলকাতা পুরসভাকে। বাড়তি এই টাকা পাচ্ছে সিইএসসি। চুক্তির চেয়ে কোথাও বেশি, কোথাও বা কম বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য গত তিন বছরে জরিমানা-সহ এই বাড়তি টাকা প্রাপ্য হয়েছে ওই সংস্থার। পুরসভা সূত্রের খবর, সিইএসসি-র বাড়তি টাকার বিল পেয়েও নড়েচড়ে বসেনি পুরসভা। কিন্তু বিষয়টিতে বাধ সেধেছে কন্ট্রোলার অব অডিটর জেনারেল (সিএজি)।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:০১
Share: Save:

একেই ভাঁড়ে মা ভবানী। তার উপরে নিজেদের ভুলের মাসুল হিসেবে বাড়তি ১৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে কলকাতা পুরসভাকে।

বাড়তি এই টাকা পাচ্ছে সিইএসসি। চুক্তির চেয়ে কোথাও বেশি, কোথাও বা কম বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য গত তিন বছরে জরিমানা-সহ এই বাড়তি টাকা প্রাপ্য হয়েছে ওই সংস্থার। পুরসভা সূত্রের খবর, সিইএসসি-র বাড়তি টাকার বিল পেয়েও নড়েচড়ে বসেনি পুরসভা। কিন্তু বিষয়টিতে বাধ সেধেছে কন্ট্রোলার অব অডিটর জেনারেল (সিএজি)। বছরের পর বছর এ ভাবে পরিকল্পনাহীন বিদ্যুৎ ব্যবহার করায় পুরসভার ভাঁড়ার থেকে যে কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে তাদের রিপোর্টে।

সম্প্রতি সিএজি-র ‘এগজামিনার অব লোকাল অ্যাকাউন্টস’ পরিকল্পনাহীন বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওই তথ্য-সহ ‘ড্রাফ্ট প্যারা’ (ডিপি) পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সরকারের কাছে। ওই ড্রাফ্ট প্যারা-তে বলা হয়েছে, পরিকল্পনা করে কাজ না করার ফলে গত তিন বছরে বিদ্যুৎ ব্যবহারের দাম ছাড়াও অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা বিল হয়েছে পুরসভার। এর সিংহভাগই জরিমানা।

মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, “আমি কিছু জানি না। খোঁজ নেব।” যদিও পুর কমিশনার খলিল আহমেদ বলেছেন, “রিপোর্ট পেয়েছি। পরিমাণ বুঝে অ্যাডজাস্ট করতে বলেছি।” যদিও সূত্রের খবর, ভবিষ্যতে যাতে পরিকল্পনা করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়, সে ব্যাপারে ডিজি (আলো)-সহ অন্য ডিজিদেরও বলা হয়েছে।

পুরসভা সূত্রের খবর, শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ১০৭টি হাই টেনশন কানেকশন সেন্টার রয়েছে। সিইএসসি ওই কানেকশন সেন্টারগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। তবে সরবরাহের আগে কোন সেন্টারে কত পরিমাণ বিদ্যুৎ দিতে হবে, তা নিয়ে আগাম চুক্তি করতে হয়। সিএজি-র অফিসারেরা নথিতে উল্লেখ করেছেন, ২০১১-১২ সালে ১০৭টির মধ্যে ৬৭টি কেন্দ্রে চুক্তি মতো বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়নি। এর ফলে শুধু ওই আর্থিক বছরে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে পুরসভার। ২০১২-১৩ সালে ৮৭টি কেন্দ্রে চুক্তির খেলাপ হয়েছে। যার জন্য পুরসভার ভাঁড়ার থেকে অতিরিক্ত ৬ কোটি বেরিয়ে গিয়েছে। আর ২০১৩-১৪ সালে ওই বাড়তি খরচের পরিমাণ ৫ কোটিরও বেশি টাকা।

কী ভাবে খরচ হয়ে যাচ্ছে এই বাড়তি টাকা?

অডিটের নথি অনুসারে, ২০১২-১৩ সালে পলতা পাম্পিং স্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তিতে বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৬০০ কিলো ভোল্ট ওয়াট (কেভিএ)। অথচ সেখানে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে ৯ হাজার ৫৭৮ কেভিএ। ২০১১-১২ আর্থিক বছরে আর একটি কেন্দ্রে ১ হাজার কেভিএ বিদ্যুৎ নেওয়ার চুক্তি থাকলেও ব্যবহার হয়েছে ৪৪০ কেভিএ। ওই সময়েই অন্য একটি কেন্দ্রে চুক্তি মতো ৬০০ কেভিএ চাহিদা থাকলেও ব্যবহার হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, ১১০০ কেভিএ। পলতার ক্ষেত্রে চুক্তি মতো বিদ্যুতের বিল হওয়ার কথা ৩ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। কিন্তু চুক্তির খেলাপ হওয়ায় বিল হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, প্রায় এক কোটি ১৯ লক্ষ টাকা বেশি।

চুক্তির খেলাপ হলে জরিমানার অঙ্কটা কত? ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশনস্ ২০১১ অনুসারে, চুক্তির চেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে অন্তত চুক্তির মোট পরিমাণের ৮৫ শতাংশ বিদ্যুতের বিল মেটাতে হবে। আর চুক্তি থেকে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হলেও, অতিরিক্ত যত কেভিএ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়েছে তার দাম এবং তার উপর ৬০ শতাংশ ডিমান্ড চার্জ হিসেবে দিতে হবে। পুরসভার ১০৭টি হাই টেনশন সেন্টারের হিসেব নিয়েছে সিএজি-র রেসিডেন্ট অডিট শাখা। গত তিন বছরের ওই হিসেবেই ১৫ কোটিরও বেশি টাকার ওই ‘অপচয়’ ধরা পড়েছে বলে পুরসভা সূত্রের খবর। শুধু তা-ই নয়, কী ভাবে গত তিন বছর ধরে ওই লোকসানের বহর বেড়েছে তা-ও হিসেব করে পুর প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছে সিএজি-র রেসিডেন্ট অডিট অফিস। তাদের দেওয়া সেই তথ্য পুর প্রশাসন স্বীকারও করেছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই রিপোর্টে।

গাফিলতির ওই ধারাবাহিকতা যাতে ভবিষ্যতে আর না হয়, তার জন্য সম্প্রতি কলকাতার পুর-প্রশাসনকেও সতর্ক করেছে সিএজি। তাদের তরফে জানানো হয়েছে, কোন কেন্দ্রে কত বিদ্যুৎ লাগতে পারে চুক্তির আগেই তার একটা হিসেব করে রাখা দরকার পুরসভার। তা হলে বাড়তি বিদ্যুতের জন্য জরিমানা (ডিমান্ড চার্জ) এড়ানো সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে পুরসভার এক আমলা জানান, পুর দফতরে, পুর বাজারে, রাস্তায় আলো জ্বালাতে বিদ্যুৎ ছাড়াও জল সরবরাহ, নিকাশি পাম্প চালানোতেও প্রচুর বিদ্যুৎ লাগে। কোন সেন্টারে কত বিদ্যুৎ লাগতে পারে, তা জানার কথা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির। ওই আমলা জানান, আলো দফতর ছাড়াও জল সরবরাহ এবং নিকাশি দফতরেও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। কোথায় কত বিদ্যুৎ লাগতে পারে, তা আগেভাগে জানিয়ে দিলে কোটি কোটি টাকা বাড়তি দিতে হত না। ওই সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cag anup chattopadhyay kolkata corporation cesc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE