Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি পড়লে তবেই আলো পায় তাঁর ‘সাধের’ ত্রিফলা

রাস্তাটির দু’পাশে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের সংখ্যা প্রায় ১০০। ঠিকঠাক জ্বলছে মাত্র গোটা দশেক। তিন বাতির স্তম্ভগুলির কোনওটায় দু’টি, কোনওটায় একটি, কোনওটিতে আবার একটি বাতিও জ্বলছে না। কোথাও আবার বাতির ব্র্যাকেট উধাও। কলকাতা পুরসভার ‘সাধের’ ত্রিফলার এই হাল উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে। উল্টোডাঙা থেকে কাঁকুড়গাছি আসার রাস্তায় বাঁ দিকে চোখ গেলেই নজরে পড়ে দু’বাহু তুলে দাঁড়িয়ে শুধুই স্তম্ভ। বেশ কয়েকটি একেবারে বাতিহীন।

সদানন্দ রোড। পড়ে রয়েছে শুধুই বাতিস্তম্ভ। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

সদানন্দ রোড। পড়ে রয়েছে শুধুই বাতিস্তম্ভ। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৩৯
Share: Save:

রাস্তাটির দু’পাশে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের সংখ্যা প্রায় ১০০। ঠিকঠাক জ্বলছে মাত্র গোটা দশেক।

তিন বাতির স্তম্ভগুলির কোনওটায় দু’টি, কোনওটায় একটি, কোনওটিতে আবার একটি বাতিও জ্বলছে না। কোথাও আবার বাতির ব্র্যাকেট উধাও। কলকাতা পুরসভার ‘সাধের’ ত্রিফলার এই হাল উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে।

উল্টোডাঙা থেকে কাঁকুড়গাছি আসার রাস্তায় বাঁ দিকে চোখ গেলেই নজরে পড়ে দু’বাহু তুলে দাঁড়িয়ে শুধুই স্তম্ভ। বেশ কয়েকটি একেবারে বাতিহীন। একই হাল দক্ষিণ কলকাতার শেক্সপিয়র সরণি, কালীঘাট সংলগ্ন সদানন্দ রোডেও। সন্ধ্যার পরে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় নজরে পড়বে ত্রিফলার ওই হাল। পুরসভা সূত্রের খবর, শহরের বিভিন্ন রাস্তায় এমন বাতিস্তম্ভের সংখ্যা প্রায় হাজার দেড়েক।

ত্রিফলার হাল খারাপ সল্টলেকেও। পিএনবি মোড় থেকে লাবণিমুখী রাস্তায় অধিকাংশ ত্রিফলার বাতিই ভাঙা। একটি জায়গায় পর পর ১১টি স্তম্ভে উল্টেপাল্টে রয়েছে ঢাকনা। বাতি তো নেই-ই।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাতায়াতের পথে যেখানেই ত্রিফলার দুর্দশা দেখেছেন, তৎক্ষণাৎ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে সজাগ করেছেন। দ্রুত তা সারানোর নির্দেশও দিয়েছেন। তবে যেখানে তাঁর নজর পড়ে না, সে সব অঞ্চলেও ত্রিফলার দশা যে ভাল নয়, তা-ই প্রমাণ করছে বিবেকানন্দ রোড, সদানন্দ রোড, শেক্সপিয়র সরণির ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ।

কলকাতাকে লন্ডনের আদলে গড়ে তুলতে আড়াই বছর আগে শহর জুড়ে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ বসাতে উদ্যোগী হয় তৃণমূল শাসিত পুরবোর্ড। পুরকর্তাদের কথায়, সেই কাজ এত দ্রুত করতে হয়েছিল যে, প্রথাগত টেন্ডার এড়িয়ে নিয়ম বিরুদ্ধ ভাবে ২৭ কোটি টাকার কাজকে পাঁচ লক্ষ টাকার নীচে ৫৪০টি ফাইলে ভেঙে ঠিকাদারদের বরাত দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ আছে, বাজার যাচাই না করেই ত্রিফলার দাম নির্ধারণ করে পুরসভার আলো দফতর। কার্যত বাজার দরের দ্বিগুণ দাম দিয়ে বাতিস্তম্ভ কেনে পুরসভা। যার ফলে পুরসভার ভাঁড়ার থেকে অতিরিক্ত প্রায় ৮-১০ কোটি টাকা বেরিয়ে যায়। আর জনগণের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে ত্রিফলা নিয়ে তদন্তে নামে কন্ট্রোলার অফ অডিটর জেনারেল (ক্যাগ)। তাদের রিপোর্টেই উঠে আসে, বাজার দরের থেকে কত বেশি টাকায় কেনা হয়েছে ত্রিফলার বাতি, ঢাকনা ও স্তম্ভ। রিপোর্টেই জানিয়ে দেওয়া হয়, এর জন্য প্রায় ৮ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে পুরসভার। সেই ত্রিফলা-কেলেঙ্কারি এক সময়ে তোলপাড় ফেলে দেয় রাজ্য রাজনীতিতে। শেষে শহরে ত্রিফলা আলো বসানো বন্ধ করতে বাধ্য হন পুর-কর্তৃপক্ষ।

বিবেকানন্দ রোড। আলো থাকলেও তা জ্বলে না। ছবি: সুদীপ আচার্য।

পুরসভার নিজস্ব অডিটেও সেই দুর্নীতি ধরা পড়ে। আলো দফতরের ডিজি-সহ একাধিক অফিসারকে ‘বলির খাঁড়া’ করে পুরবোর্ড নিজেদের ‘কলঙ্ক মোচন’-এর চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। সে সবের তোয়াক্কা না করে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও তখন বলেছিলেন, “নতুন এই আলো শহর কলকাতাকে সাজিয়ে তুলেছে। শহরের সৌন্দর্য অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।”

কিন্তু মাত্র আড়াই বছরেই ত্রিফলার হাল ভাবিয়ে তুলেছে পুর-প্রশাসনকে। পুরসভার দেওয়া হিসেব মতো, আড়াই বছর আগে শহরে ১০ হাজারেরও বেশি ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ লাগানো হয়েছিল। এর ১৫ শতাংশ অর্থাৎ, প্রায় দেড় হাজার ত্রিফলা এক ফলা, দু’ফলা বা নিষ্ফলা হয়ে রয়েছে। কোথাও বা ত্রিফলার ডাণ্ডা ছাড়া কিছুই নেই। কোথাও ভেঙে রয়েছে বাতি ও ব্র্যাকেট। তা সারানোর ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই পুর-প্রশাসনের। আলো দফতরের একাধিক অফিসারের ব্যাখ্যা, বাতি খারাপ, ব্র্যাকেট ভেঙে যাওয়ার খবর এলেই পুরসভার স্টোর কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে জানানো হয়। সেখান থেকে সরঞ্জাম সময়ে দেওয়া হয় না। ছ’মাসেও জিনিস পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ। আর স্টোর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, মাল না থাকলে সরবরাহ করব কোথা থেকে। এ নিয়ে একাধিক পুর-অফিসারের বক্তব্য, লাগানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তাই আগ্রহ বেশি ছিল। এখন রক্ষণাবেক্ষণে সেই টাকা তো নেই। পুরসভা সূত্রের খবর, কিছু রাস্তায় বাতি সারাতে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দও হয়েছে। কিন্তু সেই কাজ ঠিক হচ্ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী সিপিএমের রূপা বাগচীর অভিযোগ, “শহর জুড়ে ত্রিফলা বসানো পুরসভার একটি অর্থ অপচয়ী প্রকল্প। বেশির ভাগই খারাপ হয়ে রয়েছে। এগুলি ঠিক ভাবে দেখাশোনার জন্য পুর-পরিকাঠামোও নেই।” যদিও তা অস্বীকার করে মেয়র বলেন, “শহরের অনেক জায়গায় ত্রিফলা খারাপ হয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। কিন্তু খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি পরিবর্তন করা হচ্ছে। শুধু পুরসভাই নয়, অন্য কেউ ত্রিফলা আলো খারাপ হওয়ার খবর দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমনকী, বাতিস্তম্ভের কাচ ঘোলাটে হলেও সেগুলি পাল্টানো হচ্ছে। খারাপ হয়ে গেলে বিকল্প ত্রিফলা আলো তৈরিও আছে।” তিনি আরও জানান, বাতিস্তম্ভ চুরি ও ভাঙার ঘটনা ঘটলেও তার সংখ্যা খুবই কম।

পুরসভা সূত্রের খবর, বাতিস্তম্ভ লাগানোর মাস ছয়েকের মধ্যেই বাতি চুরির ঘটনা ঘটতে শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রী তখন মেয়রকে সতর্কও করেছিলেন। এমনকী, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বসে বাতি চুরি রোখার পন্থা বার করারও নির্দেশ দেন। কিন্তু কার্যত যে কিছুই হয়নি, তা বোঝা যায় ত্রিফলার হাল দেখেই। মাত্র ৮ মাসেই দুশোর বেশি অভিযোগ জমা পড়ে বিভিন্ন থানায়।

এক পুর-কর্তার কথায়, “লন্ডনের আদলে কলকাতাকে সাজাব বলা সহজ। ও দেশে তো এত চুরি-চামারি হয় না। রক্ষণাবেক্ষণেও কড়া নজর থাকে। এখানে তা করা যে কত কঠিন, এ বার টের পাচ্ছেন মেয়র নিজেও।” তবে বিশেষ কয়েকটি রাস্তায় ত্রিফলা খারাপ থাকলে বা বাতি না জ্বললে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা সারানো হয়।

কিন্তু কেন? পুরসভার অন্দরের খবর, আসলে নজর রাখা হয় মুখ্যমন্ত্রী যাতায়াতের রাস্তাগুলিতেই। শুধু ত্রিফলা নয়, তাঁর যাতায়াতের পথ প্রতি দিন সাফ রাখতে পুরসভার আলো দফতর থেকে শুরু করে বস্তি, জঞ্জাল অপসারণ সব দফতরই সজাগ থাকে। উদাহরণ টেনে পুরসভার এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, মাস খানেক আগেও কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে বেশ কয়েক জায়গায় ত্রিফলা আলোর হাল খারাপ ছিল। গত ১৪ জানুয়ারি ওই পথ ধরে মুখ্যমন্ত্রী নিমতলায় একটি অনুষ্ঠানে যাবেন খবর আসতেই সারিয়ে ফেলা হয় সব বাতিস্তম্ভই। আর বিবেকানন্দ রোডে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় তো ছোটেনি। তাই নজরে নেই ওই রাস্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE