Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
অনর্থের আঁধারে উদ্যোগের ক্ষীণ আলো

শিল্প সম্মেলনের অদূরেই রণক্ষেত্র শিল্পাঙ্গন

যে নিউ টাউনে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন করে রাজ্যকে তুলে ধরার তুমুল আয়োজন চলছে, বুধবার সেখানেই নির্মীয়মাণ তথ্যপ্রযুক্তির অফিসে এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘিরে রণক্ষেত্রের চেহারা নিল পরিস্থিতি। পুলিশের সামনেই দু’টি মোটরবাইক-সহ চারটি গাড়িতে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠল বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। ভাঙচুরের চেষ্টা হল দু’টি গাড়িতে। এমনকী, নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরেও আগুন লাগানোর চেষ্টা হল বলে অভিযোগ। ঘটনাচক্রে ধুন্ধুমার চলল যেখানে, তার থেকে দেড়-দু’কিলোমিটার দূরেই বসেছে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের শিল্প বৈঠক ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’।

জনরোষে জ্বলছে পুলিশের গাড়ি। বুধবার, নিউ টাউনে।  —নিজস্ব চিত্র।

জনরোষে জ্বলছে পুলিশের গাড়ি। বুধবার, নিউ টাউনে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

যে নিউ টাউনে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন করে রাজ্যকে তুলে ধরার তুমুল আয়োজন চলছে, বুধবার সেখানেই নির্মীয়মাণ তথ্যপ্রযুক্তির অফিসে এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘিরে রণক্ষেত্রের চেহারা নিল পরিস্থিতি। পুলিশের সামনেই দু’টি মোটরবাইক-সহ চারটি গাড়িতে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠল বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। ভাঙচুরের চেষ্টা হল দু’টি গাড়িতে। এমনকী, নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরেও আগুন লাগানোর চেষ্টা হল বলে অভিযোগ। ঘটনাচক্রে ধুন্ধুমার চলল যেখানে, তার থেকে দেড়-দু’কিলোমিটার দূরেই বসেছে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের শিল্প বৈঠক ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’। প্রশ্ন উঠেছে, একটি শ্রমিক-বিক্ষোভকে কেন ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল না পুলিশ? পুলিশের সামনেই যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই হাল হয়, সে ক্ষেত্রে এ রাজ্যের পরিবেশ শিল্পের পক্ষে কতটা অনুকূল প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

শহরে ওই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সব থেকে বড় ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়ার টু-র চকমাচুরিয়া এলাকায়। বেশ কয়েকটি বহুতল নিয়ে সংস্থার অফিস গড়ে উঠবে ওই ক্যাম্পাসে। গত তিন চার বছর ধরে প্রায় চার হাজার শ্রমিক সেই নির্মাণকাজে যুক্ত। পুলিশ ও স্থানীয় সুত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার দুপুরে। ওই দিন নারায়ণ মুর্মু (৩৪) নামে এক শ্রমিক নির্মীয়মাণ ক্যাম্পাসের এল ব্লকের পাঁচতলা থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হন। হাসপাতালে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার বাসিন্দা নারায়ণ দিন দু’য়েক আগেই এই কাজে যোগ দেন। শ্রমিকদের অভিযোগ, যে ঠিকাদারি সংস্থার অধীনে তাঁরা কাজ করছেন, তার কর্মীরা নারায়ণের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন। আরও অভিযোগ, নারায়ণের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বা বিমার টাকা দেওয়ার বিষয়েও ওই কর্মীরা কর্ণপাত করেননি। এ নিয়ে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত দফায় দফায় ঠিকাদারি সংস্থার সঙ্গে শ্রমিকেরা বসতে চাইলেও কান হননি ঠিকাদারি সংস্থার আধিকারিকেরা। এমনকী, এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কোনও ফল হয়নি বলে অভিযোগ। বুধবার সকাল হতে না হতেই এই নিয়ে ওই তথ্যপ্রযুক্তি অফিসের সামনে ভিড় করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন কয়েক হাজার শ্রমিক। তাঁরা গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে গেলে নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দেন। খবর দেওয়া হয় নিউ টাউন থানায়।

এ দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ পুলিশ যখন ওই অফিসের সামনে পৌঁছয়, তখন গেটের সামনে ভিড় করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন হাজার তিনেক শ্রমিক। অভিযোগ, বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করে। শ্রমিকেরা জানান, লাঠি চালানো শুরু হতেই বিক্ষোভের আগুনে যেন ঘি পড়ে। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ বা সংস্থার কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কথা শোনা দূরে থাক, উল্টে লাঠি চালানো শুরু হয়। এর পরেই উত্তেজিত জনতা ওই অফিসে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর শুরু করে দেয় বলে অভিযোগ।

গণ্ডগোল চলতে দেখে অফিসের সামনে এলাকাবাসীদের ভিড় জমে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েক হাজার শ্রমিক তাণ্ডব চালানোর খবর পেয়েও প্রথমে ঘটনাস্থলে আসেন মাত্র পাঁচ-ছ’জন পুলিশকর্মী। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “চোখের নিমেষে দেখি পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন ধরে গেল। তার পরে ওই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার একটি খাবার আনার ম্যাটাডরেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। তার পরে আগুন লাগানো হল গেটের বাইরে দাঁড়ানো দু’টি মোটরবাইকেও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা দূরে থাক, পুলিশকে তখন কার্যত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।” ভাঙচুর হয় ওই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার একটি অ্যাম্বুল্যান্স ও টাটা সুমোতেও। অভিযোগ, এর পরেই পরিস্থিতি সামলাতে লাঠি চালাতে শুরু করে পুলিশ। কয়েক জন শ্রমিক ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, “একটু দূরেই জাঁকজমক করে শিল্প সম্মেলন হচ্ছে। আর এখানে এক জন গরিব শ্রমিকের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে পুলিশের লাঠি খেতে হচ্ছে!”

ঘটনাস্থলে যায় বিধাননগর কমিশনারেটের অন্য দুই থানা বাগুইআটি ও বিমানবন্দর থানার পুলিশও। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। শুধু গাড়ি ভাঙচুরই নয়, অভিযোগ নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরও জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বিক্ষুব্ধেরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই ঘরে তখন কয়েক জন রক্ষী ছিলেন।

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সংস্থার সামনে বিভিন্ন জায়গায় পোড়া দাগ। ভাঙা কাচের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। পোড়া গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে চত্বরের ভিতরে। ঘটনাস্থলে যান বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। পৌঁছন ওই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরাও। প্রশ্ন ওঠে, কয়েক হাজার শ্রমিকদের বিক্ষোভ হচ্ছে জেনেও কেন মাত্র কয়েক জন পুলিশকে পাঠানো হল? কেনই বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রথমেই পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করল? কেনই বা সুষ্ঠু ভাবে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারল না? পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার জবাব না দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান। পরে বিমানবন্দর ডিভিশনের এডিসিপি অনন্ত নাগ বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ লাঠি উঁচিয়েছিল। কিন্তু লাঠি চালানোর কোনও ঘটনা আমার জানা নেই।” তিনি আরও বলেন, “প্রথমে কম পুলিশ ছিল ঠিকই, কিন্তু ঘটনার গুরুত্ব বুঝে দ্রুতই সেখানে তিন থানার পুলিশ হাজির হয়। ফলে পরে পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। এ নিয়ে সকালে কয়েক জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। পরে অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”

অন্য দিকে, ওই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, “কোন শ্রমিক নিয়োগ হবেন, তাঁদের সমস্যা সংক্রান্ত সব বিষয় ঠিকাদারি সংস্থাই করে থাকে। তাদেরই উচিত ছিল মৃত শ্রমিকের পরিজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টিকে আগেই নিয়ন্ত্রণ করা, বাড়তে না দেওয়া।” যদিও ঠিকাদারি সংস্থার পক্ষ থেকে হায়দার আলি নামে এক আধিকারিক বলেন, “ঝাড়খণ্ডে মৃতের পরিবারকে কী ভাবে ঘটনাটা জানানো হবে, মৃতদেহের সত্‌কার কোথায় করা হবে এ সব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। মঙ্গলবার রাতে আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ নিয়েও কথা বলেছি। বুধবার সকালে এই নিয়েই আলোচনায় বসতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ঘটনাস্থলে অনেক শ্রমিক জড়ো হয়ে যাওয়ায় আমরা পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ এসে বাড়াবাড়ি করে ফেলে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

new town accident rampage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE