Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Akshaya Tritiya

বাঙালির অক্ষয় তৃতীয়া: সে কাল আর এ কাল

পয়লা বৈশাখ বাড়ির বেশি আদর পাওয়া দুরন্ত বড়ছেলে হলে, অক্ষয় তৃতীয়া যেন সবার অলক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধমুখ লক্ষ্মী মেয়েটি।

অক্ষয় তৃতীয়া উদ্‌যাপনে জৌলুস বাড়ে কলকাতায় উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আগমনের পর।

অক্ষয় তৃতীয়া উদ্‌যাপনে জৌলুস বাড়ে কলকাতায় উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আগমনের পর।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২১ ১৭:৫৫
Share: Save:

হালখাতা! সে তো পয়লা বৈশাখ। আম বাঙালির মনোভাব এমনই। তবু বৈশাখের আরও একটা দিনেও সিঁদুর মাখানো টাকার ছাপ পড়ে লাল খেরোয় বাঁধানো খাতায়। লেখা হয় ‘ওঁ গণেশায় নমঃ’। পয়লা বৈশাখের মতো গণহারে না হলেও কিছু বিশেষ পণ্যের বণিকরা এ দিন হালখাতা করেন। গঙ্গায় পুণ্যস্নান সারেন বেশ কিছু বঙ্গজন। দেবালয়ে বিশেষ পুজোও দেন। এ দিন নতুন খাতা খোলেন সাধারণত অলঙ্কার বা রত্ন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পয়লা বৈশাখের তুলনায় অক্ষয় তৃতীয়ার উদ্‌যাপনে জৌলুস যেন খানিক কম। পয়লা বৈশাখ বাড়ির বেশি আদর পাওয়া দুরন্ত বড়ছেলে হলে, অক্ষয় তৃতীয়া যেন সবার অলক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধমুখ লক্ষ্মী মেয়েটি।

বাঙালি কবে থেকে পালন করছে এই দিনটি? প্রশ্ন করা হয়েছিল কলকাতা-বিশেষজ্ঞ হরিপদ ভৌমিকের কাছে। পুরাণ আর ইতিহাস মিলিয়ে তিনি শোনালেন এক আশ্চর্য কাহিনি। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, প্রাচীন ভারতে যে দিনপঞ্জি অনুসৃত হত, তাতে বছরের প্রথম মাসটির নাম ছিল ‘মাধব’ আর বছরের শেষ মাসটির নাম ছিল ‘মধু’। এই মধু আর মাধবকে ভগবান বিষ্ণুর মাস বলে মনে করা হত। মাধব মাসে গ্রীষ্মে জলাভাব দেখা দিত। সেই কারণে এই মাসে জলসত্র, জলদান ইত্যাদিকে পুণ্যকর্ম বলে গণ্য করা হত। তার বাইরে অন্য মূল্যবান বস্তু দানেরও রেওয়াজ ছিল সে কালে।

হরিপদ জানালেন, ‘পদ্মপুরাণ’ ব্যতিরেকে বাকি সব পুরাণেই চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে সত্যযুগের সূত্রপাত ঘটে বলে ধরা হয়। এক মাত্র ‘পদ্মপুরাণ’-এই মনে করা হয় এই দিন সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগ আরম্ভ হয়েছিল। বাংলার মানুষ ‘পদ্মপুরাণ’-এর মতকেই মানতেন। বাকি আর্যাবর্তে, অর্থাৎ উত্তর ভারতে বিশ্বাস ছিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন সত্যযুগ শুরু হয়। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলার মানুষ এই দিনটিতে দানকার্য ও পূজাপাঠের উপর জোর দিতেন। উত্তর ভারতে এই দিন পূজাপাঠ হলেও দিনটিকে ‘সঞ্চয়ের দিবস’ হিসেবে পালন করা হত। কলকাতা শহরের আদিপর্বেও অক্ষয় তৃতীয়ায় বাঙালি দানধ্যান, জলসত্র স্থাপন, ইত্যাদি করতেন, ব্রাহ্মণভোজন করাতেন। খাতা পুজো চালু হয় অনেক পরে, জানালেন হরিপদ।

পয়লা বৈশাখের মতো হইচই নেই, বরং এই পার্বণ জুড়ে রয়েছে লক্ষীশ্রী।

পয়লা বৈশাখের মতো হইচই নেই, বরং এই পার্বণ জুড়ে রয়েছে লক্ষীশ্রী।

পয়লা বৈশাখ আসলে রাজা শশাঙ্কদেবের গৌড়াধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার দিন। অনেক পরে মুঘল সম্রাট আকবর ফসলি বছরের হিসেবে এই দিন খাতা পুণ্যাহ চালু করেন। পয়লা বৈশাখ সে দিক থেকে দেখলে একটা তারিখ মাত্র। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও ধর্মীয় কোনও মাহাত্ম্য নেই। তুলনায় অক্ষয় তৃতীয়া তিথি-নক্ষত্র মেনে একটি পুণ্যদিবস। তার উপরে আবার ইংরেজ কোম্পানি নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে বাঙালির ছুটির দিনের একটা তালিকা তৈরি করতে বলায় নদিয়াধিপ সেই তালিকায় অক্ষয় তৃতীয়াকে স্থান দেন। দিনটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। তবে দোকানে দোকানে খাতা পুজোর চল শুরু হয় নাকি ১৯৩৭-’৩৮ সালের পরে। এই সময়ে উত্তর ভারতীয়রা বা আরও বিশদ ভাবে বললে, মাড়োয়ারি সম্প্রদায়, কলকাতায় তাঁদের ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন এ দিন সত্যযুগের সূত্রপাত ঘটেছিল এবং তাঁরাই এই দিন বাণিজ্যের খাতায় জমার ঘরে খানিক সঞ্চয় দেখাতে চান। শুরু হয় সোনা-রুপো বা অন্য মূল্যবান দ্রব্যের কেনাবেচা। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কলিকাতায় চলাফেরা’ গ্রন্থে তেমনটাই দেখিয়েছেন। পুরনো বড়বাজারেও নাকি আগে অক্ষয় তৃতীয়া নিয়ে ততটা মাতামাতি ছিল না। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিক থেকেই সেখানেও বাড়তে থাকে এই তিথির গুরুত্ব।

পুরনো পঞ্জিকায় অক্ষয় তৃতীয়া নিয়ে তেমন উল্লেখ যে পাওয়া যায় না। তা বোঝা যায় শিল্পের ইতিহাস চর্চাকারী অসিত পালের ‘আদি পঞ্জিকা দর্পণ’-এও। সেকালের পাঁজিতে উল্লিখিত বিভিন্ন উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত লিখলেও আর সে সবের একাধিক ছবি দিলেও গ্রন্থকার অদ্ভুত ভাবে নীরব অক্ষয় তৃতীয়া নিয়ে। ‘হালখাতা’ হিসেবে তিনি পয়লা বৈশাখের কথাই লিখেছেন। সেই সংক্রান্ত পঞ্জিকা-কাঠখোদাইয়ের বিশ্লেষণও করেছেন। কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া বিষয়ে সেকালের পাঁজিও উচ্চবাচ্য করেনি। অসিত পাল তাঁর সংগ্রহে থাকা হালখাতার যে ছবিগুলি এই বইতে রেখেছেন, তার শেষতমটি ১৯২৩ সালের। তা হলে কি অক্ষয় তৃতীয়ার হালখাতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই পালিত হতে শুরু করে?

উত্তর দিতে পারেন একমাত্র এ দিনের উপাস্য দেবতা বাবু গণেশ। তা তিনিও তেল-সিঁদুরে চকচকে হয়ে কুবের আর লক্ষ্মীদেবীকে পাশে নিয়ে লাড্ডু আর ঘোলের সরবতেই মজে থাকেন। ইতিহাসের সাল-তামামির কূটকচালে জড়ানোর ইচ্ছে কি আর আছে তাঁর? বরং আজকের অক্ষয় তৃতীয়া যেন কলকাতার মহানাগরিক সংস্কৃতির কথাই বেশি করে বলে। উত্তর ভারতীয় বণিক সংস্কৃতি আর গৌড়-বঙ্গ-পুন্ড্র-বরেন্দ্রের পুণ্যার্থীর মনোভাব মিলেমিশে এ এক ছিমছাম উৎসব। সোনার দোকানে, সামান্য অলঙ্কারের সামান্য দেনা শোধ করে যে উজ্জ্বল মুখচ্ছবি নিয়ে বেরিয়ে আসেন মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির বাঙালি পরিবারের গৃহবধূ, সেখানেই যেন ফুটে উঠতে থাকে রাজা কুবেরের ধনরাশির স্নিগ্ধ ছটা, বক্রতূণ্ড মহাকায় বাবু গণেশের আদর, মা লক্ষ্মীর কোমল হাতের স্নেহচ্ছায়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Akshaya Tritiya Special Event
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE