Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...

ঐতিহ্য ও বাস্তবতার এক নিবিড় দায়বোধ

সিমায় চলছে যোগেন চৌধুরীর একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ।ভারতের ১৯৬০এর দশক পরবর্তী আধুনিকতাবাদী চিত্রকলায় যোগেন চৌধুরীর অন্যতম প্রধান অবদান এটাই যে প্রবহমান পরম্পরাগত শিল্পশৈলী দিয়ে তিনি সাম্প্রতিকের গভীর গভীরতর সংকটের চিত্ররূপ তৈরি করেছেন।

শিল্পী: যোগেন চৌধুরী।

শিল্পী: যোগেন চৌধুরী।

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৪ ০৮:৩১
Share: Save:

ভারতের ১৯৬০এর দশক পরবর্তী আধুনিকতাবাদী চিত্রকলায় যোগেন চৌধুরীর অন্যতম প্রধান অবদান এটাই যে প্রবহমান পরম্পরাগত শিল্পশৈলী দিয়ে তিনি সাম্প্রতিকের গভীর গভীরতর সংকটের চিত্ররূপ তৈরি করেছেন। ষাটের দশকের শিল্পীদের একটি অন্বিষ্ট ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের রূপগত সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে এই সময়ের স্পন্দনকে প্রতিভাত করা এবং সেই সঙ্গে বিশ্বগত উত্তরাধিকারের প্রেক্ষাপটে নিজস্ব ঐতিহ্যগত এক আত্মপরিচয় গড়ে তোলা। যে কয়েক জন শিল্পী এই কাজটি খুব সফল ভাবে করতে পেরেছেন, যোগেন চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। ১৯৫৫ থেকে সম্প্রতি পর্যন্ত অনেকগুলি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তাঁর সৃষ্ট রূপ (ফর্ম) বিবর্তিত হয়েছে। সেই বিবর্তনের ভিতর একটি কেন্দ্রীয় ঐক্য কাজ করেছে। তা হল, ঐতিহ্য ও সমসাময়িক বাস্তবতা সম্পর্কে নিবিড় দায়বোধ।

সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে তাঁর ছবির একটি পূর্বাপর প্রদর্শনী। প্রস্তুতিপর্ব থেকে সম্প্রতি পর্যন্ত মোট ১৫৩টি কাজ নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী।

এই প্রদর্শনীতে বিশেষ ভাবে দেখানো হয়েছে তাঁর প্রস্তুতিপর্বের কাজ। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তাঁর আর্ট-কলেজ জীবনে করা এত ছবি একসঙ্গে কোনও প্রদর্শনীতে খুব বেশি দেখা যায়নি। নব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রভাব তখন অনেকটাই ব্যাপক ছিল। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য জলরঙের তিনটি ছবি: ১৯৫৬-র ‘মেলা’, ১৯৫৭-র ‘শীতের সকাল’ এবং ১৯৫৮-র ‘মাছ ধরা’। পরম্পরাগত আঙ্গিককে যে প্রস্তুতিপর্বেই তিনি নিবিড় ভাবে আত্মস্থ করেছেন, এই তিনটি ছবিতে সেই পরিচয় রয়েছে।

কিন্তু ষাটের দশকের দায়বোধ একেবারেই ভিন্নধর্মী। ১৯৪০-এর দশকের শিল্পীদের সবচেয়ে তাড়িত ও যন্ত্রণাক্ত করেছিল তেতাল্লিশের মন্বন্তর। ষাটের শিল্পীদের বাস্তব চেতনায় স্ফুলিঙ্গ জ্বেলেছিল দেশভাগ ও উদ্বাস্তুর মিছিল। দেশত্যাগের বাস্তব অভিজ্ঞতা শিল্পীর নিজেরও ছিল। সেই প্রতিবাদী দায়বোধই আজ পর্যন্ত নানা ভাবে বিবর্তিত হয়ে আসছে তাঁর ছবিতে। আর্ট কলেজ পর্যায়ে তিনি যে শিয়ালদা স্টেশনে রিফিউজিদের স্কেচ করেছেন, মানব-মানবীর শরীরের নিহিত তমিস্রা উন্মোচনের সূচনা হয়েছিল সেখান থেকে। সেই তমিস্রাই পরিপূর্ণ রূপ পেল ১৯৬৫-র তেলরঙের একটি ছবিতে যার শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘নরকের প্রতিনিধি’ বলে।

যোগেন চৌধুরীর আঙ্গিকের বিবর্তনকে তাঁর অবস্থান অনুযায়ী কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া যায়। ১৯৬৫ থেকে ৬৭ তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন প্যারিসে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ভ্রমণ করেছেন। মানুষের শরীরের রূপায়ণে অভিব্যক্তিবাদী বাস্তবতা প্রগাঢ় হয়েছে এই পর্যায় থেকে। ১৯৬৮ থেকে ৭২ তিনি ছিলেন তত্‌কালীন মাদ্রাজে উইভার্স সার্ভিস সেন্টারের চাকরি নিয়ে। তাঁত-শিল্পের বুননের মধ্যে যে পরম্পরার প্রতিফলন, সেই বুনোট আত্মস্থ হয়েছে এই পর্যায়ে। ‘রেমিনিসেন্সেস অব ড্রিম’ বা ‘স্বপ্নের স্মৃতি’ নামে যে চিত্রমালা তৈরি হয়েছিল এই পর্যায়ে তাতে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব-সঞ্জাত কল্পরূপের ভিতরে ঐতিহ্যগত সেই শিকড়ের স্পন্দন ছিল। এই পর্যায়ে তাঁর যে স্বকীয় রূপকল্প, যেখানে কুণ্ডলী পাকানো সাপের ভিতরে উদ্ভাসিত থাকে প্রস্ফুটিত পদ্ম, এর অনন্যতা অসামান্য। কিন্তু এই ‘মিস্টিসিজম’-এ তিনি বেশিদিন আটকে থাকেননি। ১৯৭২ থেকে ৮৭ দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনের চিত্রশালার কিউরেটরের চাকরি তাঁকে সাহায্য করেছে রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রটিকে বোঝার। কাঁঠালের রূপে যে ‘বুদ্ধিজীবি’-র (দ্য ইনটেলেকচুয়াল) ছবি এঁকেছেন ১৯৭৩-এ, তাতে রয়েছে সেই অভিজ্ঞতারই প্রকাশ। এর পর শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষকতায় যোগ দেন ১৯৮৭ তে। ১৯৯৯-তে সেখান থেকে অবসর নেন।

শান্তিনিকেতন তাঁর মধ্যে প্রকৃতি ও লৌকিক পরম্পরার যে বোধ জাগিয়েছে, তা নানা ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে ২০১১তে কালি-তুলি ও প্যাস্টেলে করা একটি চিত্রমালা। পাশাপাশি তিনি এঁকে চলেন শৃঙ্খলিত বিপন্ন মানবতার ইতিবৃত্ত। এই প্রদর্শনীর প্রথম ছবিটিই এর অসামান্য দৃষ্টান্ত। শিরোনাম: ‘হোমেজ টু নন্দীগ্রাম (অন পিকাসো)’। ২০০৮-এ আঁকা এই ছবিতে পিকাসোর তীক্ষতার সঙ্গে পরম্পরাগত ছন্দিত রেখার অসামান্য সমন্বয় ঘটেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jogen choudhury cima
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE