পঞ্চাশ বছরের অগ্রন্থিত কবিতা, ১৭টি সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া। কবিরা সকলেই নারী, তাঁদের মধ্যে ছত্রিশ জনের পরিচয় জানা গেছে। এমন সংকলন (অগ্রন্থিত অনুভব/ সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালি নারীর কবিতা ১৮৫০-১৯০০, সম্পা: মনস্বিতা সান্যাল। কৃতি, ৩০০.০০) সম্পাদনা নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ। ভূমিকায় রোম্যান্টিকতার বিভিন্ন স্বরূপসন্ধান, যুক্তির অন্বেষণ, ভক্তি, গার্হস্থ্য আর সমাজমুখীনতার প্রবণতা অনুযায়ী কবিতাগুলির বিভাজন ঘটেছে। পাঠকের মনে হতে পারে, ‘গার্হস্থ্যের বন্ধনে’ বিভাগে মানকুমারী বসুর ‘বিড়ালের ঝগড়া’ (পৃ ১৫৮-৯) ‘নারীভাবনা: অন্তরীণতা’ বিভাগে বেশি মানানসই। পুরুষ বিড়াল মেনে নিচ্ছে না যে, মেয়ে বিড়ালটিরও সমপরিমাণ খিদে পেতে পারে, বলছে, ‘মেয়েদের বাড়ানি ভাল নয়’। তাদের কলহ চলে আর খাবারের সিংহভাগ চলে যায় এক কুকুরের ভাগ্যে। কবি বলেন, ভগবানের চোখে ভাই-বোন সবাই সমান। সাহেব-প্রভুর গোলামি করা ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালি পুরুষ ঘরে ফিরে ভুলতে চাইত তার বহির্জীবনের বশ্যতা, হয়ে উঠতে চাইত অন্দরের প্রভু, তার বহির্জীবনের প্রভুর নিয়মে। এই অসহায় শৃঙ্খলার মধ্যে অসঙ্গতিও ছিল, সত্যিও ছিল। সুলিখিত ভূমিকায় আসতে পারত এ সব জটিলতার কথা। আজ বহির্বিশ্বে বাঙালি নারীর বেশ খানিক যোগদান সত্ত্বেও তো ভাঙা যায়নি মেয়েদের বাড়ানি নিয়ে সমাজ-সংসারের আপত্তি!
প্রকৃতি, ঋতু, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দেবতা থেকে পতিদেবতা, সন্তানস্নেহ থেকে সন্তানশোক, মহারানির শাসন থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু— এমন বিচিত্র সব উপকরণ উনিশ শতকের নারীর হাতে কবিতা হয়ে উঠতে চেয়েছে। তাই বলে কি সোজাসাপটা মানা চলে যে, তখনকার শিক্ষিত বাঙালি সমাজ নারীর সাহিত্য চর্চার ব্যাপারে যথেষ্ট উদার ছিল? ‘অন্তঃপুরের উদ্দীপনা’ কিংবা ‘বঙ্গকামিনীর খেদ’-এর মতো কবিতায় (পৃ ১৭০, ১৭৪) কবিরা যখন দিনানুদৈনিক যাপনের ক্ষতকে খানিকটা নিরাবরণ করতে চান, তখন পাঠক তাঁদের দেখেন ‘অনামা’ পরিচয়ে। উদারতার পরতে পরতে কি নিহিত ছিল নির্বিকল্প প্রভুত্বের স্বস্তি? এই জিজ্ঞাসার পরিসর তৈরি হল না।
তবে এত কালের অগ্রন্থিত কবিতাগুলি উদ্ধার করে সযত্নে সাজিয়েছেন মনস্বিতা সান্যাল, তাই তো বাঙালি নারীর সাহিত্য রচনার ইতিহাসে আপাত-স্নিগ্ধতার আস্তরণ ভেঙে গুরুতর সত্যি খুঁজবার পিয়াসটুকু নতুন করে জাগল পাঠকের মনে! তাঁকে অনেক ধন্যবাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy