উদারপন্থীরা বলতেই পারেন, তা-ই যদি হয়, তাতে সমস্যা কী? কেউ যদি পরিশ্রম করে ধন সঞ্চয় করেন এবং সন্তান-সন্ততিকে তার উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত করেন, তাতে কার কী বলার আছে? সমস্যা হল, আর্থিক অসাম্য থেকে তৈরি হয় ক্ষমতা বা প্রভাবের অসাম্য। আর ক্ষমতার অসাম্য যত বাড়ে, আদর্শ নীতি আর বাস্তবে যে নীতি অবলম্বন করা হয় এবং রূপায়িত করা হয়, তাদের মধ্যে ফারাকও তত বাড়ে। আইনি ও বেআইনি, অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, সব মানুষ নয় সমান! যেমন, আমেরিকায় আয়করের সর্বোচ্চ হার হল ৩৫ শতাংশ আর পুঁজির দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের থেকে লাভের ওপর সর্বোচ্চ করের হার হল ১৫%। তাই, প্রকৃত অর্থে এই কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল নয়, বরং উল্টো।
পিকেটির মতে, এই অসাম্য অনিবার্য নয় এবং করনীতির মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ১৯৯২ সালে আমেরিকায় সর্বোচ্চ অর্জনকারী চারশো করদাতাকে গড়ে আয়ের ২৬% কর দিতে হত। প্রেসিডেন্ট বুশের করের হার কমানোর নীতির ফলে ২০০৯ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ২০%। যা কমানো যায়, তা বাড়ানোও যায়। ইয়োরোপে অসাম্যের মাত্রা আমেরিকার তুলনায় কেন কম, তার সহজ উত্তর হল, করের হারের ফারাক। পিকেটির প্রস্তাব, পুঁজি থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর আদায় করা হোক, এবং পুঁজি যেহেতু সচল, তাই সব দেশেই সেটা এক হারে করা হোক।
এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। সেই রকম, তাঁর তত্ত্ব যে অভ্রান্ত বা সর্বাঙ্গীণ, তাও বলা যায় না। পিকেটি নিজেই হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, গত চার দশকে আমেরিকায় আয়ের সার্বিক অসাম্যের বৃদ্ধিতে পুঁজি-লব্ধ আয়ের অবদান এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়, যা তাঁর পুঁজি-কেন্দ্রিক তত্ত্বের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খায় না। এখানে দক্ষ শ্রম থেকে অর্জিত আয়ের ক্রমবর্ধমান অসাম্যের একটা বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়, যেমন ম্যানেজার বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারের আয় সাধারণ শ্রমিকের মজুরির তুলনায় প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে।
তা হলেও, আয় ও বিত্তের ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে পিকেটি যে গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন, তা থেকে বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন মূলধারার অর্থনীতির সুসজ্জিত প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছে। এই প্রথম দেখছি, অসাম্যের প্রসঙ্গটি এমনকী রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের গবেষণাতেও বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
বহুপঠিত কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, বহুচর্চিত এই বইটির আপাত-জনপ্রিয়তার কারণটা ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট এবং তাতে ব্যাঙ্ক আর বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর ভূমিকা অতি-ধনীদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের মনে এক গভীর বিরূপতা তৈরি করেছে। আমেরিকায় আর্থিক বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মনোভাব অনেকটাই পাল্টে গেছে— ‘ওপরের এক শতাংশ’ কথাটা এখন খুবই চালু। করদাতাদের টাকায় ব্যাঙ্কের লালবাতি জ্বলা আটকাতে হবে, এই রকম ধনীদের জন্যে ‘জিতলে ধনতন্ত্র, কিন্তু হারলে সমাজতন্ত্র’ মানসিকতার ফলে জনমানসে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর আগে আমেরিকায় রাজনীতিকরা ‘করবৃদ্ধি’ শব্দটি ব্যবহার করতে ভয় পেতেন। এখন সেই অবস্থা খানিকটা হলেও পাল্টেছে।
আসলে, অসাম্যের প্রশ্নের সঙ্গে ন্যায়ের প্রশ্নটা অঙ্গাঙ্গী জড়িত। স্থান, কাল ও পরিস্থিতিভেদে কতটা অসাম্য সামাজিক ভাবে সহনীয় বা বৈধ, অসাম্যের বিরুদ্ধে নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে শেষ বিচারে সেটাই বোধ হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এ অর্থনীতির শিক্ষক