একসঙ্গে পঁয়ত্রিশটি গল্প নাগালের মধ্যে পেলে, সে-সব গল্পের লেখককে বেশ খানিকটা চেনা যায়। কুমার রাণা অবশ্য বাঙালি পাঠকের অচেনা নন। সমাজ-অর্থনীতির সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে তাঁর বিশিষ্ট অভিজ্ঞতালব্ধ প্রবন্ধ-নিবন্ধে পাঠক অভ্যস্ত। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও হতাশাটাই যে শেষ কথা নয়, এমন ইঙ্গিতই সচরাচর এই লেখকের পর্যবেক্ষণের বার্তাবহ। এমন বার্তার বাস্তবসম্মত বহন, আবার সেই বহনকে নিছক ইচ্ছাপূরণের চৌহদ্দির তফাতে রাখা এ বড় সহজ কাজ নয়। কাজটা দুরূহতর হয়, যখন নিবন্ধের বার্তা ছড়িয়ে যায় গল্পে। বাস্তবসংগতির পাশাপাশি এসে জোটে শিল্পসম্মতির বালাই।
কুমার রাণার গল্পের ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন সমস্যা বড় একটা নেই। কারণ গল্প বানানোর কোনও দায় নেই তাঁর। অভিজ্ঞতার জমি থেকেই সটান উঠে আসে তাঁর গল্প। তেমন আবাহনে সমাজকল্যাণের ধ্বজাকে পুরোপুরি অপাপবিদ্ধ প্রমাণ করবার কোনও মিথ্যে তৎপরতাও নেই। বরং অনগ্রসর জনজীবনের জন্য শিক্ষিত সম্পন্নের হিতাকাঙ্ক্ষার ভিতরে ভিতরে, শাসনের স্তরে স্তরান্তরে, এমনকী গবেষণার পরতে পরতে কতখানি অসংগতি মিশে আছে, তার একটা নির্মোহ চিত্ররূপ খুঁজতে খুঁজতেই যেন গল্পগুলোকে নাগালে পাওয়া। ঠাকুরদের দখল করা জমির ধান কেটে আধাআধি দেওয়া হবে ভাগচাষিদের, বাকি অর্ধেক জমা রেখে চালানো হবে কেসের খরচ। মাঝি হাড়ামের এই পরিকল্পনা শুনে কথক বলে, এমন প্রকল্প একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিতে পারলেই আদত সার্থকতা। উত্তরে মাঝি হাড়াম বলে, কাজ শুরু করাটাই বড় কথা, অন্য গ্রামের মানুষ নিজের তাগিদেই যোগ দেবে। কথক লেখেন, ‘আমার সাবধানী পরিকল্পনাবাদী সুবিধাবাদী কেটে পড়ার ধান্দাযুক্ত মধ্যবিত্ত মনে... এক প্রহার।... বিছানায় শুয়ে... অবিশ্রাম প্রয়াস চালিয়ে যাই পা দিয়ে নিজের মুখে লাথি মারার। পারি না।’ (৯১)
‘অন্নদাস’ যে সংকলনের নামগল্প, সেখানেই আছে ‘বাজার’ কাহিনিটি। খোলা মনে, খোলা চোখে জীবনের দিকে তাকালেই সেখানে দৃশ্যমান হয় বাজারের বাইরের পৃথিবী, খোঁজ মেলে এমন কত মানুষের, যাদের অবস্থান সর্বাধিক উপযোগ অথবা মুনাফা অর্জনের বোধবুদ্ধি সম্পন্ন অর্থনৈতিক ব্যক্তির ঘেরাটোপের বাইরে। অন্নদাস সংকলনের শেষ গল্প ‘বাঁচি রহিতে হিবে’তে গবেষকের অর্থনীতি ভেঙে হাহাকার করে ওঠে নিতান্তই ভগ্নদেহ কিন্তু বড় বেশি রকম জ্যান্ত এক মানুষের দিনযাপনের অর্থনীতি। শাসন-শোষণ, প্রতিরোধ-আপসের পাকেচক্রে চাষির ছেলের রাজনীতিমনস্কতা জীবনযাত্রাকে করে তোলে দুরূহ। অথচ মানুষটা তো বিশ্বাস করে, সে বহুজনের স্বার্থে এ সমস্যা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।’ (পৃ ১৬৪)। তার বেঁচে থাকার অঙ্গীকারে ভিতু অথবা বশ্য মানুষের সহযোগিতা বা আশ্বাস নিষ্প্রয়োজন। উন্নয়ন অর্থনীতির ভাষায় যারা অনগ্রসর জীবনের শরিক, কুমার রাণার গল্পে তারা প্রদর্শকের, শিক্ষকের, এমনকী গবেষকের সামনে মেলে ধরে নতুন বোধোদয়ের জগৎ।