অন্তিম নিশ্বাস নির্গত হয়েছে। ওই চোখে বিশ্বসংসারের রূপ আর ছায়া ফেলবে না, ওই অধরোষ্ঠ স্ফুরিত হবে না উচ্চারণে, ওই হাতের সব কাজ শেষ। মানুষ থেকে দেহ, কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। এ ভাবনা মগজের পিছনের কোনও কুঠুরিতে ঠেলে রেখে বাস্তববাদী মানুষেরা ‘প্রোডাকটিভ’ দিন কাটায়। কিন্তু জীবন বড় অশিষ্ট। এক ঝটকায় কাপড় খুলে বলে, দেখো, অতি উৎপাদনশীল, অতি ঈপ্সিতরাও প্লাস্টিক-মোড়া হয়ে অপেক্ষা করছে ধাপায়, আবর্জনার চুল্লিতে ঢুকবে বলে। কেউ সৎকারে রাজি নয়, তাই পুত্র ডিপ ফ্রিজে রেখেছে পিতাকে। জ্যান্ত থাকলেই বা কী, সংক্রমণ হলে প্রিয়জনও পরিহার করবে তোমার দূষিত দেহ। বেঁচে থাকতে দেখে নাও, কী হবে মৃত্যু হলে। এই ভয়ানক সত্য হজম করা কঠিন, তাই মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার, চ্যবনপ্রাশ, হোমিয়োপ্যাথির পরেও মনের ডাক্তারকে ফোন— খুব ডিপ্রেশন, তীব্র অ্যাংজ়াইটি।
সাইকোথেরাপি, সাইকায়াট্রি এক রকম সমধান। আর একটা উপায় ‘ফিলজ়ফিক্যাল থেরাপি’ বা দর্শন-শুশ্রূষা। যে সব প্রশ্ন মুখে উড়িয়ে দিলেও ভিতর ভিতর বিপন্ন করে, সে সম্পর্কে দর্শনের অলিগলিতে সন্ধান। ‘জীবনের অর্থ কী?’ এ হল তেমন একটা প্রশ্ন। আর একটা প্রশ্ন, ‘আমি’ আর ‘আমার দেহ’, দুটো কি এক? বিজ্ঞান তাই বলে, অথচ বিজ্ঞান-অনুগতরাও প্রিয়জনের মৃত্যুতে টলে যায়। অকালমৃত বান্ধবীর উদ্দেশে এক তরুণীর পোস্ট, “তোকে দাহ করে ফিরতে কত রাত হল, তুই এক বার ফোন করে খবর নিলি না।” অভিমানী প্রশ্ন, আবার গুরুতর প্রশ্নও বটে। দেহের অবসানেই কি কর্তব্যের অবসান?
অরিন্দম চক্রবর্তী এ প্রশ্নগুলো বাঙালি পাঠকের কাছে তুলছেন বার বার, দিগ্দর্শীদের চিন্তার সন্ধান দিয়ে উস্কে দিতে চেয়েছেন দেহ-চিন্তা। দেহ, গেহ, বন্ধুত্ব (২০০৮), তার পর দেহ থেকে সন্দেহ (২০১৭), সেই ধারায় এই বই। ব্যক্তি, চেতনা আর দেহ— এরা কোথায় আলাদা, কেনই বা রক্ত-মাংসের দেহকে ঘিরে ঘৃণা-তাচ্ছিল্য-মুগ্ধতার ভাবোচ্ছ্বাস, লেখক দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞানের নানা গলিতে তার খোঁজ করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কেবল ‘ভগবদ্গীতা মেড-ইজ়ির আলুসেদ্ধ’ খেলে হবে না, ‘নব্যন্যায়ের সজনে ডাঁটা’-ও বাঙালির পাতে পড়া চাই। চিন্তা চিবিয়ে যাদের সুখ, তেমন উৎসুকচিত্ত পাঠকের কাছে অরিন্দমবাবুর বইগুলি সম্পদ। কিন্তু এই মহামারির কালে এ তনু ভরিয়া বইটি যে কারও জন্য একটা থেরাপিরও বটে।