বাঙালি ইতিহাস-অনুরাগীরা শেখর ভৌমিকের নামের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত। একক ও যৌথ সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি গবেষণা-নিবন্ধের সঙ্কলন (সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চা, বাংলার শহর: ঔপনিবেশিক পর্ব) এবং অধুনালুপ্ত ইতিহাসগ্রন্থের নব সংস্করণ প্রকাশ (রামানুজ করের বাঁকুড়া জেলার বিবরণ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র সিরাজদ্দৌলা) তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। আলোচ্য বইটি লেখকের পিএইচ ডি অভিসন্দর্ভের পরিমার্জিত রূপ। মুখবন্ধ ও তথ্যসূত্র বাদে বইটি আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত: প্রাক্কথন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মধ্যবিত্তের শিক্ষা আর সমাজ জীবন, মুদ্রণ সংস্কৃতি, ‘শৃঙ্খলিত’ নাগরিক জীবন: বাঁকুড়া পৌরসভা, একটি আঞ্চলিক সত্তার নির্মাণ, জনসংস্কৃতি এবং শেষের কথা। লেখকের মতে, ‘‘ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতে এবং পরিপ্রেক্ষিতে এক মফস্সল শহরের সামাজিক ইতিহাসই গ্রন্থের বিষয়বস্তু।’’ অর্থাৎ এই শহরের গড়ে ওঠাটা সামাজিক ইতিহাস শৃঙ্খলার অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক ইতিহাস কাকে বলে তার তাত্ত্বিক কূটতর্কে প্রবেশ না করেও তিনি গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ের নামকরণের মধ্যে দিয়ে তার উপজীব্যতা প্রকাশ করেছেন এক ভিন্ন আঙ্গিকে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে গ্রাম অপেক্ষা নগর চর্চার ইতিহাস কেন অবহেলিত সে ব্যাখ্যাটি তাঁর প্রাক্কথনে উপস্থিত যথাযথ প্রেক্ষিতে। বাঁকুড়ার মতো এক প্রান্তিক শহরের গড়ে ওঠার ইতিহাস রচনায় তথ্যের অপ্রতুলতা যে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তার উল্লেখ করেও চেষ্টা করেছেন তার ফাঁকগুলি পূরণ করতে। অনেক ক্ষেত্রে আশ্রয় নিয়েছেন মুখের কথার ইতিহাসে।
বিষ্ণুপুরের মতো এক ঐতিহ্যমণ্ডিত জনপদ থাকা সত্ত্বেও কিসের প্রয়োজনে বাঁকুড়ার মতো একটি অখ্যাত গঞ্জ শহরে রূপান্তরিত হয়? গোলাম হোসেন তাঁর সিয়ার-উল-মুতাক্ষরিন-এ জানিয়েছেন, বীরভূম ও বিষ্ণুপুর এই দুই অঞ্চলের জমিদাররা এতই শক্তিশালী ছিলেন যে তাঁরা মুর্শিদাবাদের নবাব-দরবারে ব্যক্তিগত হাজিরায় বাধ্য ছিলেন না। সেই শক্তিশালী বিষ্ণুপুর কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে হারায় তার পূর্বতন গৌরব এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাঁকুড়াকে জেলার সদর শহর নির্বাচনে আগ্রহী হয়ে ওঠে, তার তন্নিষ্ঠ বিবরণ আমরা পেয়ে যাই গ্রন্থের সূচনাতেই।
নগরায়ণের অন্যতম প্রধান শর্ত হল মধ্যবিত্তের উত্থান। শেখর এখানে কলকাতার মধ্যবিত্ত ও বাঁকুড়ার মধ্যবিত্তের মধ্যে একটি সীমারেখা টেনেছেন। দেখিয়েছেন বাঁকুড়ায় কী ভাবে এক ‘সাব-রিজিয়োনাল এলিট’ গড়ে উঠল, আর কেনই বা একটি শ্রেণি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি থেকে বাঁকুড়া শহরমুখি হল অথচ গ্রামের সঙ্গে তাঁদের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটল না। এই টানাপড়েনের প্রতিফলন ঘটল মানসিকতাতেও, যা ছিল আধুনিক মনন গড়ে ওঠার পথে এক অনিবার্য প্রতিবন্ধকতা। অথচ ‘মুদ্রণ সংস্কৃতি’ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদ স্ফুরণে ও অন্যান্য নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে সীমাবদ্ধ কিন্তু আন্তরিক এক অভীপ্সা। বিভিন্ন সাময়িক পত্রপত্রিকা, বিশেষত ‘বাঁকুড়া দর্পণ’ সংবাদপত্রের সুগভীর আলোচনায় লেখক দেখিয়েছেন যে বাঁকুড়ার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও নানা সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন ছিল এই পত্রিকাগুলি। পত্রপত্রিকার প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য আর সামাজিক ইতিহাসের দর্পণ হিসেবে সাময়িকপত্রের ভূমিকা তো সুবিদিত।